একজন কবির সাক্ষাৎকার | কবির কল্লোল
: আপনার কাব্যগ্রন্থ ঘেটেঘুটে তো কিছুই তেমন পেলাম না। কয়েকটি আধভাঙা মাছের কাঁটা, কিছু গরুর হাড় আর ধানের চিটা পড়ে আছে।
- কবিতাই লিখেছিলাম। জীবন্ত কবিতা। 'পুকুর ভরা মাছ', 'গোয়াল ভরা গরু' আর 'গোলা ভরা ধান' শিরোনামে।
: কিন্তু কিছুই তো পেলাম না। পাঠক তো বলছে, আপনি কবিতা করতে এসে কাঁটাকুটো, হাড়গোড় ছড়াচ্ছেন। কবিতার জাত গেলো রবও উঠছে।
- আসলে একজন হিংসুক কবি আছে। সেও লেখে ভালো। জীবন্ত। আমার কবিতা পড়েই সে লিখলো 'রেলের কালো বিড়াল', 'সুন্দরবনের বাঘ' আর 'গেঁয়ো ইঁদুর'। তারপর...
: বুঝেছি বুঝেছি। যথাক্রমে আপনার কবিতাগুলো সে খেয়ে দিলো। তো আপনি এখন নিঃস্ব।
- আমিও প্রস্তুতি নিচ্ছি। এখন লিখছি 'মন্ত্রীর বিশ্বাসঘাতক ড্রাইভার', 'রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র' ও 'ইঁদূর দেখেছো, ফাঁদ দেখোনি' শিরোনামে জীবন্ত কবিতা।
: আচ্ছা আচ্ছা। এবার আপনিও খেয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছেন। মানে খেয়ে দেওয়াদেওয়িই আপনাদের কবিতা?
- খেয়ে দেয়ার ভেতরে কিঞ্চিৎ কাব্যিকতার অভাব আছে। বলতে পারেন কবিতা কামড়াকামড়ি।
: বেশ। তো উনিও যদি কামড়াতে আসেন? ধরুন উনি লিখলেন 'প্রধানমন্ত্রীর ছত্রছায়া', 'ইউনেস্কোর
হস্তক্ষেপ' কিংবা 'আমেরিকান বন্ধু' প্রভৃতি শিরোনামের জীবন্ত কবিতা...
- এটা একটা চক্র। দেখুন, চক্রটার দরকার আছে। সে আমাকে খাবে, আমি তাকে খাবো; মানে ঐযে
কামড়াকামড়ির প্রবাহমানতা ধরে রাখাটা জরুরি। তা না হলে কবিতা টিকবে না, বিলীন হয়ে যাবে।
: কিন্তু কামড়াকামড়িতেও তো কবিতা ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে। পূর্বের কবিতাকে গিলে খাচ্ছে পরের কবিতা।
- হ্যাঁ। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু খাচ্ছেটা কে? বা কে কাকে কামড়াচ্ছে? কবিই তো কবিকে
কামড়াচ্ছে। এই অধিকার কবিদের আছে। আবার কোনো রাজনীতিবিদ বা ধরেন আমলা কামড়াতে এলেও কিন্তু পারবে না। কারণ কামড়াকামড়ি একটা শিল্প। কুকুরের পর একমাত্র কবিরাই এই শিল্প রপ্ত করতে পেরেছে। এটা একটা উল্লেখযোগ্য অর্জন।
: এমন কোনো কবিতা লেখা সম্ভব যেটা জীবন্ত কিন্তু এমন অখাদ্য-কুখাদ্য বা অরুচিকর যে টিকে যাবে?
- 'টিকিয়া থাকাই চরম সার্থকতা নয়, অতিকায় হস্তি লোপ পাইয়াছে কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে'। সস্তা বা তেলাপোকা টাইপ কবিতা লিখলে টিকতেও পারে। তবে চেষ্টা করে যাচ্ছি, যদি একটাও মানসম্মত কবিতা টিকিয়ে দিতে পারি। একবার 'মানুষের মল' শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলাম। কবিতা থেকে তাজা দুর্গন্ধ বের হচ্ছিলো। ভেবেছিলাম এটা টিকে যাবে। কিন্তু 'ক্ষুধার্ত কুকুর' নামে অন্য একটি কবিতা সেটাও খেয়ে দিলো। এখন মাথায় ঘুরছে 'কীটনাশক' শিরোনামে একটি কবিতা। দেখা যাক...
: অক্ষরবৃত্তের বৃত্তেই আপনাকে ঘুরপাক খেতে দেখা যাচ্ছে। বলা যায় হাবুডুবু খাচ্ছেন। অন্য ছন্দের প্রতি কি কোনো বিতৃষ্ণা বা অপারগতা আছে?
- প্রথমত আপনি ভুল বললেন। আমি কোনো ছন্দ মেনেই লিখি না। ছন্দকে আমি বরাবরই অপছন্দ করে আসছি। গদ্যই আমার প্রধান হাতিয়ার। মিল দিয়ে কবিতা লেখা একটা রাবিশ।
: তারমানে দেখা যাচ্ছে মিল বা 'অন্ত্যমিল' দেয়াকেই আপনি ছন্দ মনে করেন।
- না না। মোটেই তেমন নয়। মানে আপনার ধারণা ঠিক নয়। ছন্দ আমি জানি। কিন্তু লিখি না। মানে
নিজের মতো লিখি। ছন্দে পড়লে পড়ে, না পড়লে না পড়ে। যেমন আপনি বললেন অক্ষরবৃত্তে আমার কবিতা ঘুরছে। ছন্দ না জানলে তো এটা আসে না। কিন্তু কাব্যিকতার চেয়ে আজকাল গাদ্যিকতার গুরুত্বটা বেশি। ফলে ছন্দ এলেও একটানা লিখে দিই। দেখতে তো গদ্যের মতোই লাগে।
: গদ্য কবিতাতে কি অন্ত্যমিল থাকতে পারে না?
- গদ্য তো গদ্যই। মানে পারে কি? আপনার কি মনে হয়?
: আমার কিছু মনে হয় না। বলতে পারেন জানা নেই।
- এটা একটা সমস্যা। লিখতে হলে, পড়তে হলে, সাক্ষাতকার নিতে হলে জানতে হবে। আজকাল তো সব হীরক রাজার দেশের মতো অবস্থা। যেনো- 'জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই'।
: আচ্ছা আচ্ছা। তো কবিতায় আপনি কোন ধরণের ঈঙ্গিত দিতে চান? আপনার তো প্রায় সব কবিতাই দুর্বোধ্য মনে হয়।
- আমি চিন্তা নিয়ে খেলতে পছন্দ করি। আসলে পরাবাস্তবতা এখানে এখনো খুব নতুন। বলা যায় কেউ
লেখেইনি তেমন। ফলে প্রাথমিক পর্যায়ের একটা ভুল বুঝাবুঝি তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া আপনাকে বিশ্লেষণী হতে হবে, কবির মস্তিষ্কের মধ্যে ঢুকতে হবে। কিন্তু পাঠক এই সামান্য পরিশ্রমটুকু করতে চায় না। যেনো সব দায় কবির একার। যেমন ধরুন আমার একটা লাইন 'চোখ তার মাচানের লাউ'। চোখ কেনো লাউ হতে যাবে? এই প্রশ্ন নির্বোধরা করে। অথচ একটু ভাবলেই তারা মূল ভাবনাটা ধরতে পারবে।
: চোখ, লাউ, মাচান - ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলতেন যদি...
- খুবই সোজা। লাউ ঝুলছে মাচানে। লাউ কীসের মতো? স্তনের মতো। স্তন কীসের মতো? ডাবের মতো। ডাব কীসের মতো? চাঁদের মতো। চাঁদ ঝুলছে আকাশে, অর্থাৎ মাচানটা আকাশ। চাঁদের মতো জ্বলজ্বলে তার চোখ। মাত্র তিনটা ধাপ আপনি চিন্তা করবেন না?
: অর্থাৎ পাঠককে ঢুকতে হবে কবির মস্তিষ্কে? কবি কেনো পাঠকের মস্তিষ্কে ঢুকতে পারছে না?
- পারবে না কেনো? অবশ্যই পারছে। আমার বন্ধুরা তো প্রথম পাঠেই সব ধরতে পারে, বাহবা দেয়। তারাও পাঠক এবং অতি উৎকৃষ্ট পাঠক।
: কিন্তু অন্য কবির বন্ধুরা আপনার লেখা বা অন্যান্যদের লেখা বুঝতে পারছে না। আবার আপনার বন্ধুরাও অন্যদের লেখা আমলে নিচ্ছে না। তাহলে উৎকৃষ্ট পাঠক দেখা যাচ্ছে আলাদা আলাদা প্যানেলভুক্ত। ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে না?
- আপনাকে ক্লাস বুঝতে হবে। ক্লাসই মূলকথা। কুরুচি আর সুরুচির পার্থক্যটা এখান থেকেই স্পষ্ট হয়।
: হ্যাঁ। ক্লাস। তা বটে। অর্থাৎ শ্রেণী বিভাজন। কিন্তু সর্বসাধারণ? যারা কারও বন্ধু না, তাদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?
- দে নিড টু রিড মোর; স্পেশালি বাংলা কবিতা। সমসাময়িক কবিতা বেশি বেশি পড়তে হবে। আর সহজবোধ্যতার নামে সস্তা কবিতাগুলো ছুড়ে ফেলতে হবে।
: ধন্যবাদ। আপনার সমৃদ্ধি, সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করি। আবার কথা হবে। কবিতা কামড়াকামড়ি চালিয়ে যাবেন প্রত্যাশা রাখি।
- জয়তু কবিতা ।
Post a Comment