আলস্য | তৌকির হোসেন
ইফতারের পর খুব একটা আলসি আলসি ভাব জাগে। ছোট ছোট অনেকগুলো হাই তুলে বিছানায় লম্বা হওয়া এক অতি-আবশ্যকীয় কাজ এই রোজা রমজানের দিনে। ঢাকা যে বাসায় আসছি চট্টগ্রামে, নয় দিনও হয় নাই, বাপ মা আমার আচরণ প্রত্যক্ষ করে পুরোই হতভম্ব। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে, আমি নাকি সারাদিন বাসায় বসে থাকি কিংবা শুয়ে থাকি অথবা কখনো সখনো দুই একখানা সাহিত্যগ্রন্থের পাতা উল্টাই। সেহরি খেয়ে ঘুমাতে যাই ভোর পাঁচটায়। আর উঠি দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে এরকম সময়ে। অবশ্য মাঝেসাঝেও উঠতে হয় মায়ের চেঁচামেঁচি শুনে, বেধাম্মিক হয়ে যাচ্ছি, রোজা আছে নামায নাই ইত্যাদি অপবাদ ভুল প্রমাণ করবার জন্যে। ঘুমের মধ্যে মানুষ যেমনে হাঁটাহাঁটি করে, আমি পানি দিয়ে কেমনে সেমনে ওযু করি, জায়নামাজে দুই তিনবার কপাল ঠেকাইয়া উঠে পড়ি এবং পুনরায় গভীর ঘুমে মজে যাই। এর মাঝে যে কত ঘন্টা যায় সেই ঘন্টাগুলোয় বাসার নিচে কোন দুইটা মহিলার ভেতর কাইজ্জা লাগলো না কোন মুরগি (সাদা বা কালো) জান দিল রহমান চাচার শান দেওয়া ধারালো ছুরির নিচে না পাশের বাসার কোন পিচ্চি সুঃ সুঃ করে দিলো দরজায়, ঈদের জন্যে কিনে আনা নতুন পাপোশে - এসবের গন্ধ আমার নাকে এসে পৌঁছায় না। যদি কেউ বলে কেন, তাইলে বলব আমি ঘুমে থাকি, আমার হিসাব থাকে না।
অথচ আমি কাউরে বিশ্বাস করাইতে পারব না, ঢাকা শহরে আমি কেমন ব্যস্ত থাকি। ব্যক্তিগত ব্যস্ততার আগে আগে শহরটা কেমন ব্যস্ত থাকে বিশেষত ক্যাম্পাস সেইটা একটু জানান দেওয়া দরকার। এইজন্যে আমাদের বেশিদূরে যাওয়ার দরকার হবে না। টিএসসিকে ছোটখাট মডেল ক্যাম্পাস বা শহর (কেননা এখানে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না আরও বহু মানুষের পদধূলি পড়ে) হিসেবে ধরে আমরা আগাইতে পারি। বেশিরভাগ মানুষ ক্যাফেটেরিয়াতে স্থান পায় না কারণ ওইটা মানুষে ভরা থাকে। তাই মেঝেতে বসতেই আরাম লাগে সবার। কাজের ভিত্তিতে বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা যায়। এই যেমন তাস খেলা এখানে একটা অপরিহার্য কাজ, জনা বিশেক ছেলেমেয়েদের এখানে পাবেন যারা দক্ষ খেলুড়ে। আবার অনেক অদ্ভুত কিসিমের লোকজনও থাকে, ধরেন একজন থাকেন ছাত্রলীগের কর্মী। নাম আবার বলা যাবে না। ইনি সুন্দর করে শার্ট প্যান্ট পরে এসে মাথায় হাত দিয়ে বুদ্ধাসনে লম্বা হয়ে আধশোয়া হয়ে শিস বাজান। ধরেন কোন একদল গান করতেসে, "মধু হই হই আঁরে বিষ খাওয়াইলা" তখন তিনি আর চুপ থাকতে পারেন না। মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে না মাথায় কিঞ্চিত সমস্যা আছে সেজন্যে শিস থামিয়ে আরেকখানা গান ধরেন, একা একা কেন ভালো লাগে না। তবে একক সঙ্গীত দিয়ে যে দলীয় সঙ্গীতের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এটা কিন্তু অনেক কৌতূহলোদ্দীপক। তিনি বাদে আর সাধারণ মানুষজন অনেক ব্যস্ত থাকেন এখানে প্রেম করবার কাজে। হৃদয় বিনিময়ের ছবিগুলো আমাদের ভুলিয়ে দেয় যে এই জায়গা এককালে হয়তোবা কখনো ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র ছিলো। তবে এটা সত্য টিএসসি এখনও টিএসসি। মানুষ বদলাইসে, জায়গা বদলায় নাই।
আমি এ সমস্ত ছোট ছোট কাজের ধার ধারি না। আমার কাজগুলো হয়ে থাকে খুবই সামাজিক ও গঠণমূলক। সামাজিক কাজগুলোর মধ্যে একটা ধরেন, 'কাজ' না থাকলে কারাসের সামনে টঙে বসে বসে চা খাওয়া। এই কাজটা এত দ্রুত শেষ হয় না। এক দেড় ঘন্টাতো লাগেই। উঠতে ইচ্ছা করে না জায়গা থেকে- এইটা গৌণ কারণ। মুখ্য কারণ বুঝবার জন্যে আপনাদের চিন্তা করা লাগব। এই যে দেখেন, একে তো আমি কাপের পর কাপ চা খেয়ে শফিক মামার রুজিরোজগারের একটা গতি করে দিচ্ছি, আবার আমার সাথে সাথে যে সমস্ত মানুষজন থাকে যেমন: রেহমান, আনিস, পলাশ, সুবোধ তারা যখন টঙের বেঞ্চিগুলোও দখল করে ফেলে, এক দেড় ঘন্টাতে যতগুলো সিগারেটের ফিল্টার মাটিতে ও যতগুলো খালি স্বচ্ছ কাপ স্টিলের ট্রেতে জমা হয় তাতেই এটা পরিষ্কার হয় আমরা কিভাবে, দায়িত্বের সহিত শফিক মামার দৈনিক ভরণপোষণে অবদান রাখছি। এটাকে যদি সামাজিক ধরি তাহলে গঠণমূলক কাজ হয় একটু অন্যরকম কিন্তু একই সাথে আগেরটার সাথে যুক্ত। চা-সিগারেট খেয়ে আমাদের শরীর যেভাবে চাঙা হয় তাতে আমরা যে সমস্ত বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠি ধরেন তার রেঞ্জও বিশাল- বর্তমান অর্থমন্ত্রীকে কে সুস্থ না কে শক্তিশালী বললো, কোন রাজনৈতিক কবির কবিতা কতখানি অশুদ্ধ বা বিশুদ্ধ হলো, কেন এই বইমেলার বর্তমান বইগুলো পরিহার্য, বা কেন আমাদের আলোচনা চালাতেই থাকা উচিত হুট করে কোন কাজে হাত দেবার আগে ইত্যাদি নিয়ে ঘন্টাখানেক তর্ক বিতর্ক করবার পর -
১. আমাদের মুখের বাচনভঙ্গী সুন্দর হয়,
২. আমাদের মননে বিশ্লেষণী দক্ষতার ছাপ পড়ে এরকম মানসিক ব্যায়াম করবার পর আর যাই হোক মশাই, নিজেকে অলস দাবি করতে পারব না।
তবে ইদানিং বাসায় এসে কেন জানি বেশি অলস হয়ে যাচ্ছি। এই যেমন আজকে ইফতার করবার পরে ঘুম ঘুম চোখে আরাম করে শহীদুল জহিরের "মহল্লার বান্দর, আব্দুল হালিমের মা এবং আমরা" গল্পটা পড়ছিলাম। গল্পটা পড়তে পড়তে শেষের একটা জায়গায় এখলাসউদ্দীনের কথা পাই। কিন্তু এই এখলাসউদ্দীনকে গল্পে কানেক্ট করতে পারছিলাম না। নিশ্চিত যে এখলাসউদ্দীনের কথা কয়েক পৃষ্ঠা আগে গেলে আবার পাব তখন ভালো করে ব্যক্তিটিকে মনে পড়বে। কিন্তু ওই পৃষ্ঠা ক'টা উল্টিয়ে এখলাসউদ্দীনের পরিচয় জানতে বেদম ইচ্ছা করলেও শক্তিতে আর কুলাইলো না। আবার না পারছিলাম ভালো করে চিনতেও। ফলস্বরূপ, "এই গল্প শেষ হয়েও হইলো না শেষ" এবং " সবকিছু জেনে ফেললে অজানা থাকলো কি" দুটো সান্ত্বনার কথা নিজেকে শুনিয়ে গল্প শেষ করে বই পাশে রেখে দিলাম। বালিশ একটু পাড়াপাড়ি করে শান্তিমতো তাতে মাথা দিলাম। রাত নয়টাও বাজে নাই এখনও। সেহরির বহু দেরি। শুধু শুধু শক্তির অপচয় না করে আপাতত ঘুমানোতেই কল্যাণ নিহিত।
অথচ আমি কাউরে বিশ্বাস করাইতে পারব না, ঢাকা শহরে আমি কেমন ব্যস্ত থাকি। ব্যক্তিগত ব্যস্ততার আগে আগে শহরটা কেমন ব্যস্ত থাকে বিশেষত ক্যাম্পাস সেইটা একটু জানান দেওয়া দরকার। এইজন্যে আমাদের বেশিদূরে যাওয়ার দরকার হবে না। টিএসসিকে ছোটখাট মডেল ক্যাম্পাস বা শহর (কেননা এখানে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না আরও বহু মানুষের পদধূলি পড়ে) হিসেবে ধরে আমরা আগাইতে পারি। বেশিরভাগ মানুষ ক্যাফেটেরিয়াতে স্থান পায় না কারণ ওইটা মানুষে ভরা থাকে। তাই মেঝেতে বসতেই আরাম লাগে সবার। কাজের ভিত্তিতে বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা যায়। এই যেমন তাস খেলা এখানে একটা অপরিহার্য কাজ, জনা বিশেক ছেলেমেয়েদের এখানে পাবেন যারা দক্ষ খেলুড়ে। আবার অনেক অদ্ভুত কিসিমের লোকজনও থাকে, ধরেন একজন থাকেন ছাত্রলীগের কর্মী। নাম আবার বলা যাবে না। ইনি সুন্দর করে শার্ট প্যান্ট পরে এসে মাথায় হাত দিয়ে বুদ্ধাসনে লম্বা হয়ে আধশোয়া হয়ে শিস বাজান। ধরেন কোন একদল গান করতেসে, "মধু হই হই আঁরে বিষ খাওয়াইলা" তখন তিনি আর চুপ থাকতে পারেন না। মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে না মাথায় কিঞ্চিত সমস্যা আছে সেজন্যে শিস থামিয়ে আরেকখানা গান ধরেন, একা একা কেন ভালো লাগে না। তবে একক সঙ্গীত দিয়ে যে দলীয় সঙ্গীতের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এটা কিন্তু অনেক কৌতূহলোদ্দীপক। তিনি বাদে আর সাধারণ মানুষজন অনেক ব্যস্ত থাকেন এখানে প্রেম করবার কাজে। হৃদয় বিনিময়ের ছবিগুলো আমাদের ভুলিয়ে দেয় যে এই জায়গা এককালে হয়তোবা কখনো ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র ছিলো। তবে এটা সত্য টিএসসি এখনও টিএসসি। মানুষ বদলাইসে, জায়গা বদলায় নাই।
আমি এ সমস্ত ছোট ছোট কাজের ধার ধারি না। আমার কাজগুলো হয়ে থাকে খুবই সামাজিক ও গঠণমূলক। সামাজিক কাজগুলোর মধ্যে একটা ধরেন, 'কাজ' না থাকলে কারাসের সামনে টঙে বসে বসে চা খাওয়া। এই কাজটা এত দ্রুত শেষ হয় না। এক দেড় ঘন্টাতো লাগেই। উঠতে ইচ্ছা করে না জায়গা থেকে- এইটা গৌণ কারণ। মুখ্য কারণ বুঝবার জন্যে আপনাদের চিন্তা করা লাগব। এই যে দেখেন, একে তো আমি কাপের পর কাপ চা খেয়ে শফিক মামার রুজিরোজগারের একটা গতি করে দিচ্ছি, আবার আমার সাথে সাথে যে সমস্ত মানুষজন থাকে যেমন: রেহমান, আনিস, পলাশ, সুবোধ তারা যখন টঙের বেঞ্চিগুলোও দখল করে ফেলে, এক দেড় ঘন্টাতে যতগুলো সিগারেটের ফিল্টার মাটিতে ও যতগুলো খালি স্বচ্ছ কাপ স্টিলের ট্রেতে জমা হয় তাতেই এটা পরিষ্কার হয় আমরা কিভাবে, দায়িত্বের সহিত শফিক মামার দৈনিক ভরণপোষণে অবদান রাখছি। এটাকে যদি সামাজিক ধরি তাহলে গঠণমূলক কাজ হয় একটু অন্যরকম কিন্তু একই সাথে আগেরটার সাথে যুক্ত। চা-সিগারেট খেয়ে আমাদের শরীর যেভাবে চাঙা হয় তাতে আমরা যে সমস্ত বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠি ধরেন তার রেঞ্জও বিশাল- বর্তমান অর্থমন্ত্রীকে কে সুস্থ না কে শক্তিশালী বললো, কোন রাজনৈতিক কবির কবিতা কতখানি অশুদ্ধ বা বিশুদ্ধ হলো, কেন এই বইমেলার বর্তমান বইগুলো পরিহার্য, বা কেন আমাদের আলোচনা চালাতেই থাকা উচিত হুট করে কোন কাজে হাত দেবার আগে ইত্যাদি নিয়ে ঘন্টাখানেক তর্ক বিতর্ক করবার পর -
১. আমাদের মুখের বাচনভঙ্গী সুন্দর হয়,
২. আমাদের মননে বিশ্লেষণী দক্ষতার ছাপ পড়ে এরকম মানসিক ব্যায়াম করবার পর আর যাই হোক মশাই, নিজেকে অলস দাবি করতে পারব না।
তবে ইদানিং বাসায় এসে কেন জানি বেশি অলস হয়ে যাচ্ছি। এই যেমন আজকে ইফতার করবার পরে ঘুম ঘুম চোখে আরাম করে শহীদুল জহিরের "মহল্লার বান্দর, আব্দুল হালিমের মা এবং আমরা" গল্পটা পড়ছিলাম। গল্পটা পড়তে পড়তে শেষের একটা জায়গায় এখলাসউদ্দীনের কথা পাই। কিন্তু এই এখলাসউদ্দীনকে গল্পে কানেক্ট করতে পারছিলাম না। নিশ্চিত যে এখলাসউদ্দীনের কথা কয়েক পৃষ্ঠা আগে গেলে আবার পাব তখন ভালো করে ব্যক্তিটিকে মনে পড়বে। কিন্তু ওই পৃষ্ঠা ক'টা উল্টিয়ে এখলাসউদ্দীনের পরিচয় জানতে বেদম ইচ্ছা করলেও শক্তিতে আর কুলাইলো না। আবার না পারছিলাম ভালো করে চিনতেও। ফলস্বরূপ, "এই গল্প শেষ হয়েও হইলো না শেষ" এবং " সবকিছু জেনে ফেললে অজানা থাকলো কি" দুটো সান্ত্বনার কথা নিজেকে শুনিয়ে গল্প শেষ করে বই পাশে রেখে দিলাম। বালিশ একটু পাড়াপাড়ি করে শান্তিমতো তাতে মাথা দিলাম। রাত নয়টাও বাজে নাই এখনও। সেহরির বহু দেরি। শুধু শুধু শক্তির অপচয় না করে আপাতত ঘুমানোতেই কল্যাণ নিহিত।
Post a Comment