নারী | মাইশা তাবাস্সুম

ছেলেটাকে আজকে আড়ং এ দেখা মাত্রই ক্রাশ খেলাম। কালো আর হলুদ রঙ্গের পাঞ্জাবী মাঝখানে ফাঁকা অংশ দিয়ে তাকে দেখার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলাম।
ইচ্ছা করেছিলো, তার সাথে কথা বলি। জিজ্ঞাস করতে ইচ্ছা করেছিলো, তার ফেসবুক আইডি আছে কি না!!! কিন্তু প্রকৃতির দেয়া জড়তার কাছে আমি দায়বদ্ধ ছিলাম, পারি নি তাকে জিজ্ঞাস করতে।।।
সে যখন হাতে মেরুন রঙ্গের পান্জাবীটা নিয়েছিলো তখন আমি কপালের চামড়া কুচকিয়ে তাকে আমার বিরক্তির ভাব বুঝিয়ে দিয়েছি, তাকে বুঝিয়ে দিয়েছি পান্জাবীটা তাকে মানাবে না।।।
তাই সেও মেরুনের পরিবর্তে আকাশি রঙ্গের শর্ট পান্জাবীটা হাতে নিলো।। আর পান্জাবীটা এক দেখায় পছন্দ হওয়ার মতো ছিলো তাই আমিও কপালের চামড়া ঠিক করে, ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম, পান্জাবীটা আসলেই সুন্দর।

আড়ং-এর কুর্তি গুলা আমার ভীষণ পছন্দের।। যতকিছুই হোক, আড়ং-এ গেলেই একটা কুর্তি কেনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করি।।। আজও দেখছি।। পছন্দও হয়েছে কিন্তু তাও নিতে পারছি না।।।
যদি আমি একা আসতাম তাহলে হয়তো নিয়ে নিতাম কিন্তু আজ তো এসেছি নিজেকে রুপবতী,গুণবতী ললনা হিসেবে প্রকাশ করতে।।। সামনে এবং আশেপাশে ঘোরাঘুরি করা ৬/৭জন মানুষের সামনে নিজেকে প্রকাশ করতে।।। তারা কিন্তু আড়ং-এ কেনাকাটা করতে আসি নি বরং আমাকে তাদের ঘরের "পুত্রবধূ" করা যায় কি না সে পরীক্ষা নিতে এসেছে।।।
ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও নিজের সবচেয়ে দামী সালোয়ার কামিজটা পরে, সুন্দর করে মেকআপ দিয়ে, গাঢ় কালো কাজল দিয়ে তাদের সামনে রোবোর্টের মতো হাঁটাহাটি করছি।।। নিজের চেহারার মাঝে বিনয়ী ভাব ধরে রাখতে হবে যেনো তারা বুঝতে পারে, আমি তাদের বাড়ির বউ হওয়ার প্রচেষ্টায় কোন প্রকার কমতি রাখি নি।

তারাও খুব ভালো ভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাকে দেখছে যেনো আমার চুল, নাক, হাতের আঙ্গুল, হাঁটায় কোন প্রকার কমতি থাকলে তা যেনো তাদের চোখের আড়াল না হয়।।
আমি যখন পান্জাবীর সাইড থেকে শাড়ীর সাইডে আসি তখনও না ঐ ছেলেটাকে ই দেখতে পাই।।। তাকে দেখলেই মাথায় জমে থাকা সব ক্লান্তি আর বিরক্তবোধ মুছে যায়।।। কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে থাকা তো আমার পক্ষে অসম্ভব, এটা আমার রীতি নীতির বিরুদ্ধে যায়।।।
নিজেকে অন্যের সম্পদ করার প্রচেষ্টায় সে মালিকের সামনে এসে, অন্য শোরুমের মালিকের দিকে তাকানোটা প্রকৃতির বিরুদ্ধে যায়।।। তাই আমিও ঘুরে ফিরে ফরমাল গেটআপ নেয়া ছেলেটাকেই দেখার চেষ্টা করি।

ছেলেটার তার গেটআপে বুঝিয়ে দিলো তিনি সম্পদ, অর্থ বিত্তে কোন অংশ কম নয় এবং তার চেহারায় প্রকাশ পায় তিনি আমাকে জীবন সঙ্গী নয় বরং বাসার সো-পিজ হিসেবে পেতে চায়।।।
ইচ্ছা করছে এই সবকিছু ছেড়ে বের হয়ে যাই, সে ছেলেটার সাথে কথা বলি।।। নিজের ইচ্ছাটা প্রকাশ করি কিন্তু আজ ভার্সিটি লাইফের সবচেয়ে প্রতিবাদী মেয়ে নীরা ও বন্ধী প্রকৃতি,সমাজ আর পরিবারের কাছে।
প্রেম!!! প্রথম দেখায় প্রেমে পড়া বলতে আমি শুধুমাত্র সেদিন দেখা আড়ং এর ছেলেটাকেই বুঝি।।। কি অদ্ভুত তাই না, আমার বিয়ে পয়সাওয়ালা এক ব্যবসায়ীর সাথে ঠিক হয়েছে অথচ আমি কি না এখনও সে ছেলের প্রেমে পড়ি!!! শুধু প্রেমে পড়েছি বললে ভুল হবে, বরং তার প্রেমে রীতিমত হাবুডুবু খেয়ে যাচ্ছি।।
তার কথা চিন্তা করলে শরীর কেমন জানি ঠান্ডা হয়ে যায়।। তাপহীন শরীরের লোমগুলা কেমন জানি খাড়া হয়ে যায়।

আচ্ছা ছেলেটা কি আমাকে খেয়াল করেছিলো??? তার কি আমাকে আপন মনে হয়েছিলো??? আচ্ছা, সে কেনো সেদিন আমার পছন্দকে গুরুত্ব দিয়েছিলো??? সে কেনো মেরুন পান্জাবীর পরিবর্তে আমার পছন্দ করা আকাশী পান্জাবী কিনেছিলো??? সে কি আমার কথা চিন্তা করে???
আমি সবসময়ই প্রশ্নের প্যাঁচানো খেলায় আটকা পড়ি, আজও পড়েছি।।। কিন্তু এই প্যাঁচানো খেলায় বিভ্রান্ত হয়ে নেয়া সিদ্ধান্ত বরাবরই ভুল হয় আর যার প্রমাণ পেয়েছিলাম আজ থেকে ছয় মাস আগে।।
যখন রাকিবকে বলেছিলাম, "নাহ!! তোমার সাথে আমি আর সম্পর্ক রাখতে পারবো না।।। প্লিজ, আমার ভালোর জন্য হলেও আমার সাথে আর যোগাযোগ করিও না।।।"""
৪বছর যাবৎ ভালোবাসার মানুষটাকে যখন ছয় মাস আগে কথাটা বলি তখন নিজেকে সর্বহারা মনে হয় কিন্তু তাও বলতে হয়।।। পরিবার সমাজের কাছে সেদিন আমার ভালোবাসা হেরে গিয়েছিলো।। আমি হেরে গিয়েছিলাম, আমার বিবেক, আবেগ, চাহিদা, ব্যক্তিত্ব, সত্ত্বা সবকিছু হেরে গিয়েছিলো।।।
আমি নিজেকে ভুলতে পারি তবে তাকে ভুলতে পারি না।।। কিন্তু তাও তাকে ভুলে থাকার পরীক্ষাটা দিয়েই যাচ্ছি।।।  সেদিন আম্মু একটা কথাই বলেছিলো "হয়তো তুই আমার হয়ে আমার মতো থাকবি অথবা তুই সব ত্যাগ করে ঐ ছেলের কাছে যাবি।।"""

আর আমিও আম্মুর হয়ে থাকার তাগিদে নিজের অস্তিত্বকেই বিলীন করে দিলাম।।। আম্মু হয়তো সেদিন মনে করেছে, আমাকে শুধু রাকিব থেকে দুরে রাখার প্রচেষ্টায় আম্মু সক্ষম হয়েছে কিন্তু আম্মু জানেই না সে আমাকে রাকিব থেকে নয় বরং আমার অস্তিত্ব থেকে দুরে রেখেছে।।।
ছেলেটা আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো।।। গত বছর ডিসেম্বরে ছেলেটাকে ফাইজলামী করে রাত আট টা করে  বলেছিলাম, "তোমার দর্শন নিয়ে কালকে কলেজে যাইতে চাই।।।"""
আর সে ছেলেও তার সেমিস্টার ফাইনাল এক্সাম বাদ দিয়ে আমার সাথে ঢাকা থেকে দেখা করতে এসেছে তাও সকাল সাড়ে আট টায়।।।এই শর্ট টাইমে সে কিভাবে আসলো তা শুধু সে নিজেই জানে।।। আমি শুধু জানি, সে আমাকে আর আমি তাকে ভালোবাসি।।। তার জন্য সব করতে পারি, তবে আম্মুর কথার কাছে নিজেকে শেষ করতে বাধ্য হতেই হলো।।। আম্মু আর দুই ভাই বোন ছাড়া আমার আর কেউ ছিলো না।। মহিলাটা খুব কষ্ট করে আমাকে লালন পালন করছে।।। আমি পারি না, আমার ভালোবাসার কাছে আম্মুর কষ্টকে বিলীন করে দিতে।।। রাকিব আমার অস্তিত্ব কিন্তু আম্মু আমার অস্তিত্ব দাতা ।
গত পরশু যখন আড়ং-এ রাকিবকে পান্জাবী কিনতে দেখি তখন আমার ইচ্ছা করেছিলো তার ভালোবাসা কন্ঠে "কেমন আছো??? আমি আজও তোমাকে ভালোবাসি" কথাটা শুনতে।।।।
রাকিবের কথা কেন জানি আজ সকাল থেকে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।।। সেদিন আড়ং-এ ছেলেটাকে দেখার পর ছয় মাস আগে বন্ধ করে দেয়া ভালোবাসার বইটাকে আর বন্ধ রাখতে পরছি না।।।
ইচ্ছে করছে রাকিবকে একটা ফোন কল করি কিন্তু করার মতো সাহস পাচ্ছি না।।। ছেলেটা অনেক কষ্টে আমাকে ভুলে বেঁচে আছে, তাকে যদি কল দি তাহলে হয়তো সে আর শক্ত থাকতে পারবে না।।।
অনেক কথা ই মাথায় ঘুরছে কিন্তু মন শুধু একটা জিনিস ই চায়, রাকিবের শব্দ শুনতে।।।
অনেক চিন্তা ভাবনা করলাম, ঠিক করেছি তাকে আর কল দিবো না।।।
অথচ বিকেল বেলায় সে শব্দে সেভ করা নাম্বারে কল দিয়েই দিলাম।। তিন বার কল দেয়ার পর ছেলেটা কল রিসিভ করেছে।। সে আমার নতুন নাম্বারটা চিনে না তাই বোধ হয়, কল রিসিভ করতে এতটা দেরী করলো রাকিব।।।
রাকিব: হ্যালো!!!(৪বার বললো)
রাকিব: আরে কি আজব মানুষ কথা না বললে, কল কেন দিছেন!!!!
আচ্ছা আপনি কি নীরা??? যদি ভুল বলে থাকি তবে সরি।।। বাট আপনি কে বুঝতাছি না তো তাই।।।
আমি: হ্যালো!!!
রাকিব: নীরা!!! (জোর গলায়) তুমি ভালো আছো??? আচ্ছা সেদিন তোমাকে কেমন জানি রোগা রোগা মনে হয়েছিলো!!! তোমার আম্মু ছিলো সাথে তাই আর কথা বলি নি।।। জানো, সেদিন আড়ং-এ ইরফান( রাকিবের বন্ধু) এর জন্য পান্জাবী কিনতে গিয়েছিলাম কিন্তু তুমি পছন্দ করেছিলা পান্জাবীটা তাই আর ইরফানকে দি নাই।।।
নীরা, তুমি কিছু তো বলো!!! কতদিন তোমার শব্দ, তোমার শাসন শুনতে পাই নি!!!! আজ তো কিছু বলো, প্লিজ।।।।
আমি: আরে তুমি আমাকে কথা বলার সুযোগ দিলেই না বলবো!!! তোমার এত প্রশ্ন এত কথার মাঝে তো আমিই সুযোগ পাচ্ছি না।।।
রাকিব: ও হ্যা তাই তো।।। আসলে এতো কথা জমে আছে তোমাকে বলার জন্য যা হয়তো আজ সারাদিন বললে ও শেষ হবে না।।। জানো, প্রতিটা রাতেই ঘুমানোর আগে তোমার ভয়েস রেকর্ড শুনি কিন্তু সে রেকর্ডে কোন প্রাণ খুঁজে পাই না।।। তোমার শব্দ পাই তবে তোমার নিশ্বাস, হৃদ স্পন্দন অনুভব করতে পারি না।।।।
আমি: ভালো আছো তুমি????
রাকিব: সেদিন তো দেখতেই পাইলা, বেঁচে আছি আমি।।।
আমি: আচ্ছা, রাখি।। ভালো থেকো।।।
রাকিব: আচ্ছা, আর কয়েকটা মিনিট কি তোমার শব্দ শোনা যায় না??? প্লিজ!!!!
আমি: আমার বিয়ের কথা চলছে।।।
রাকিব: বাদ দাও না এ কথাটা।।। কিছুটা সময় তো আমার অস্তিত্ব আমারই থাকুক।।। (কাঁদো কাঁদো কন্ঠে)
নীরা: আচ্ছা।।


এই ছেলেটার সাথে ১ঘন্টার বেশি কথা বলছি।।। এতটা সময় যে কখন আর কিভাবে চলে গেলো বুঝতে ই পারলাম না।।।
সন্ধ্যার পর আম্মুর কাছে কল আসছে, ঐ ছেলে পক্ষ আমাকে পছন্দ হয়েছে।। তারা আমাকে তাদের পুত্রবধূ করতে ইচ্ছুক।।।
আগামীকাল সকাল ১১টায় ছেলেটার সাথে রেস্টুরেন্টে দেখা করার প্রোগ্রাম ঠিক হয়েছে।।। আম্মুর মুখ থেকে জানতে পারলাম ছেলেটার নাম পাভেল।।
আম্মুকে অনেক ভাবে বলার চেষ্টা করেছি, "আম্মু আমি এই বিয়ে করতে চাই না।।।""" কিন্তু কথাটা কেনো জানি মুখ দিয়ে বের হয় নি আম্মুর সামনে।।। কিভাবে বের হবে বলুন, কোন মা যখন তার মেয়ের মাথা বুকে রেখে বলে "আজ আমার সব কষ্ট শেষ, রাতে আরাম করে ঘুমাবো।।""" তখন কি মুখ দিয়ে কথা বের করা যায়!!!!!!
রাকিবকে রাত বারো টায় আবার কল দিলাম।।।
আমি: রাকিব, প্লিজ কিছু করো আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলছে আম্মু।।। (তখন কেনো জানি মাথায় শুধু রাকিবই ছিলো।।। আম্মুর কথা কেনো জানি মাথা থেকে মুছে গিয়েছিলো।।।)
রাকিব: নীরা কান্না বন্ধ করো।।। আমি তোমার আম্মুর সাথে কথা বলি।।।
আমি: আম্মু কষ্ট পাবে।।।
রাকিব: আর ভালোবাসা???
আমি: তুমি চাও, আম্মুকে কষ্ট দি।।।
রাকিব: একদমই নাহ।।।
আমি: একটা কাজ করবা???
রাকিব: কি??
আমি: তুমি ঐ ছেলে(পাভেল) এর খোঁজ খবর নাও।।।
রাকিব: তোমার ভবিষ্যত জামাইর সাথে যেনো ভালো থাকতে পারো তাই আমি খবর নিবো।।।
আমি: আরে নাহ!!!! দেখো, তুমি পাভেল সম্পর্কে জানবা।। সে কাকে বেশি পছন্দ করে, কোন মানুষটার কথা বেশি শোনে তা বের করবা।।। তারপর সে মানুষটাকে আমাদের সম্পর্কের কথা বলবা।। তিনি যেনো পাভেলকে বোঝায়।।।
রাকিব: তুমি পাগল নাকি!!!! এটা সম্ভব আদৌ????
নীরা: জানি না।।।
রাকিব: আচ্ছা, ফজরের আযান দিচ্ছে নামায পড়ে ঘুমাও।।। কাল চিন্তা করবো কি করা যায়।।।।
নীরা: তুমিও ঘুমাই ও।।।। ভালোবাসি!!!
রাকিব: অনেক বেশি ভালোবাসি।।।

সকাল থেকে রাকিবকে না হলেও ৫০বারের বেশি কল দিছি।।। ছেলেটা কখনও ই আমার কল রিসিভ করতে দেরী করে না।। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার কল রিসিভ করার জন্য মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকে সে।।। একবার ও EBL Bank এ ইন্টার্নশিপের জন্য ভায়বা দিতে গিয়েছিলো।। ও যখন ভায়বা বোর্ডে সবার সামনে তখন ওকে আমি কল করি আর ছেলেটা হাদারামের মতো সবার সামনে বলে "স্যার সরি, বউ কল দিছে।।। প্রেগন্যান্ট বউ সো কল টা রিসিভ করতে হবে প্লিজ পাঁচ মি দেন।।।।""" এই ছেলে কল রিসিভ করে পাঁচ মি কথা বলছে, এর মাঝে ওকে অনেকবার ভায়বা নি প্রশ্ন করলে সে বার বার কথাটা ইগ্নোর করে।।। পাঁচ মিনিট কথা শেষে বলে, "শোন, আমি না ভায়বা বোর্ড থেকে বের হয়ে তোমার কল রিসিভ করছি এখন গিয়ে ভায়বা টা দিয়ে আসি।।।"""" সেদিন ছেলেটাকে খুব বকা দিয়েছিলাম কিন্তু বকা দিয়ে লাভ নাই, ছেলেটা অদ্ভুত।।। তার আর ইন্টার্নশিপ করা হলো না ব্যাংকটা তে।।
কিন্তু আজ, ছেলেটা এতো কল করার পর ও কল রিসিভ করছে না।।। আর এখন তো দেখি মোবাইল বন্ধ।।। রাকিব জানতো, আজ আমার পাভেলের সাথে দেখা করার কথা।।। এগারোটা বাজে ছেলেটা আমাকে নিতে আসবে অথচ আর আছে ২৫মি বাকী এগারোটা বাজার।।। ছেলেটা বোধ হয় আমাকে কিছুক্ষনের মাঝেই নিতে আসবে অথচ রাকিবের কোন খবর পাই নি।।। অদ্ভুত ছেলে রাকিব, আবার কি পাগলামী করে আল্লাহ ই জানে।।।
আজ আমি কালো রঙ্গের সলোয়ার কামিজ পড়েছি।।। আম্মু খুব বকা দিয়েছে, কেনো আমি কালো রঙ্গের কামিজ পড়েছি।।। কিন্তু আম্মু তো আর জানে না, আজকের দিনটা আসলেই আমার জন্য শোক দিবস।।। নিজের ভালোবাসাকে কোরবান দিয়ে অন্য কারো সাথে দেখা করতে গেলে কি আর কেউ ভালো থাকতে পারে!!!!
যাই হোক, তার সাথে ঘুরতে যেতে হবে আর আমি বাধ্য।।। এটাই হচ্ছে সত্য কথা আর এটাই মানতে হবে।।।

পাভেল আমাকে নিয়ে তার পরিবারের সাথে বিয়ের শাড়ী কিনতে এসেছে মার্কেটে।।। আমার ভবিষ্যত শশুড় পক্ষের ইচ্ছা আমি যেনো হালাকা রঙ্গের যেমন; মিষ্টি কালার, পিংক কালার... লেহেঙ্গা কিনি কিন্তু আমি তো টকটকে লাল রঙ্গের বেনারসি কিনতে চাই।।।
রাকিব সবসময় বলতো, "যুগ হয়তো বলবে তোমাকে বিয়েতে লেহেঙ্গা পড়ার কথা কিন্তু আমি চাই তোমাকে টকটকে লাল রঙ্গের শাড়ীতে দেখতে।।" ও সবসময় বলতো, "যুগ যেমন ই হোক তুমি কিন্তু ডালা শাড়ি পড়বা, ব্লাউজ কিন্তু থ্রী কোয়াটার হাতা দিবা, বড় লাল টিপ পড়বা।।। তুমি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সাজবা না বরং আমার ইচ্ছা মতো নিজেকে সাজাবা""""
আমি যখন লেহেঙ্গা কিনতে আপত্তি করেছিলাম তখন পাভেলের দুই বোন ই খুব বিরক্ত হয়েছিলো।।। তারা আমার ভালো লাগাটাকে গুরুত্ব দিতে চায় ন।।।। কিন্তু পাভেল ছেলেটা অন্য রকম ছিলো।।। তিনি প্রথম সমস্যাতেই আমার পাশে ছিলো।।। তার বোনদেরকে বলেছিলো ""দেখ, আমারও শাড়ী পছন্দ, উনি যেহেতু শাড়ী চায় তবে তা ই কিনা হোক।।। বিয়েটা তো উনার।।।""""
শাড়ী এবং বিয়ের অন্যান্য জিনিস কেনা শেষে ছেলেটা আমাকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে।।। ছেলেটার সামনে আমি রোবোটের মতো বসে আছি।।।
হঠ্যাৎ সে বলে উঠলো,
পাভেল: আপনি কি কম কথা বলেন???
আমি : নাহ তো!!!
পাভেল: আমার সাথে কথা বলবেন না, এমন কোন প্রতিজ্ঞা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছেন???
আমি: তা কেনো হবে।।।
পাভেল: কেমন আছেন???
আমি: ভালো।।।
পাভেল: কি করেন???
আমি:  এইচএসসি দিলাম।।।  আর এখন ভার্সিটির এডমিশন যুদ্ধে আছি।।।। তবে তা বিয়ে যুদ্ধের জন্য বন্ধ আছে।।।
পাভেল: এখন কি করেন??? এই মুহূর্তে।।
আমি: বসে আছি।।
পাভেল: আপনাকে একটা প্রশ্ন করি???
আমি: এতক্ষন যাবৎ তো তা ই করছেন।।। আচ্ছা বলেন।।
পাভেল: আপনার কি কোন সমস্যা আছে??? আমাকে অপছন্দ করেন??? আমি আপনাকে কিছু আজাইরা প্রশ্ন করছি আর আপনিও তার উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন।। পাল্টা কোন প্রশ্ন ও করেন নি।।।
আমি: উত্তর দিতে বাধ্য আমি তাই দিচ্ছি।। আপনাকে আমি অপছন্দ করি না, এটা সত্য কথা।।। কিন্তু তার চেয়ে বড় সত্য আপনাকে আমি পছন্দ ও করি না।।।
পাভেল: বয়ফ্রেন্ডের সাথে কি সবসময় ঝগড়া করতেন নাকি??? এখনও সে স্বভাব রয়ে গিয়েছে।।।
আমি: যেহেতু বয়ফ্রেন্ডই রয়ে গেছে তাহলে সে স্বভাব থাকাটাও স্বাভাবিক।।।
পাভেল: আপনি অনেক ভাগ্যবতী তো আপনার বয়ফ্রেন্ড এখনও বেঁচে আছে!!!!
আমি: বেঁচে আছে মানে কি!!!! সে এখনও সুস্থ, স্বাভাবিক, ভালো আছে এবং আমার হয়েয়ে আছে।।।
পাভেল: আরে প্লিজ রাগ করিয়েয়েন নাহ।।। আসলে আমার গার্লফেন্ড আমার হাত ছেড়ে দিয়েয়েছে তো তাই।।। আমার গার্লফেন্ড এত বছর আমার বাগানের গাছ ছিলো কিন্তু ফুল হয়ে গেলো অন্যের ঘরে।।।
আমি: আমার মতো অবস্থা।।।
পাভেল: আপনারা মেয়েরা ও পারেন বটে।।।
আমি: পারতে হয়।।।
পাভেল: এখন কি আমাকে বিয়ে করবেন???
আমি: ইচ্ছা নাই।।।
পাভেল: আপনার বয়ফ্রেন্ড কি জানে, আজ আমাদের দেখা হচ্ছে।।। আমাদের বিয়ে ঠিক।।।
আমি: হুম।।। বাট সে চাইলে ও কিছু করতে পারবে না।।।
পাভেল: আমার আবার বউ খোঁজার যুদ্ধে নামতে হবে???
আমি: নামলে ভালো হয়।।
পাভেল: আপনি আমাকে সাহায্য করিয়েন।।।
আমি: চেষ্টা করবো।।।
পাভেল: এ কথা ই থাক।। আপনার নাম্বার আমার কাছে।। আর আমার নাম্বারটা কল দিয়ে আপনাকে দিয়ে দিবো।। বউ ঠিক হইলে কল দিয়েন।।।
আমি: একটা কথা বলি।।
পাভেল: যাক আপনি নিজ থেকে কথা তো বলতে পারেন!!! বলেন।।
আমি: আমার আম্মুকে
পাভেল: আর বলতে হবে না।। বুঝতে পারছি।। বিয়ে যেহেতু হবে না সেখানে আমার দোষ থাকবে।।।
পাভেল আমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দেয়ার সময় দেখি বাসার সামনে ইরফান (রাকিবের বন্ধু)।।
আমি: ইরফান ভাই, আপনি এখানে।।। রাকিবকে সকাল থেকে কল দিচ্ছি ও তো ধরে নি।।।
ইরফান: ও ব্যস্ত ছিলো।।। তোমার সাথের ছেলেটা কে??
আমি: পাভেল।।
ইরফান: ওর সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে???
আমি: হুম।। তবে এখন ভেঙ্গে দিয়েছি।।।
ইরফান: উনাকে নিয়ে চলো, রাকিবকে সারপ্রাইজ দি।।
আমি: ঠিক আছে চলুন।।।
আমি যখন আজকে রাকিবকে দেখি তখন শুধু চোখ দিয়ে পানি পড়েই যাচ্ছে।।। ওকে যে কিছু বলবো সে অবস্থা ছিলো না।। ছয় মাস ছেলেটা থেকে দূরে ছিলাম আর যা আজ দেখা হলো তাও কিছু বলতে পাচ্ছি না।।।
আমাট শরীর শক্ত হয়ে যাচ্ছে।। নিজের কান্নার আওয়াজটাও নিজে শুনতে পাচ্ছি না।।। আমি রাকিবের চেহারা দেখে এতোটুকু বুঝতে পেরেছি সে আমাকে বলছে,
রাকিব: কষ্ট পাচ্ছো???
আমি: চুপ।।।
রাকিব: প্লিজ কষ্ট পেও না।।। তোমার কষ্ট যে আমাকে ভীষন কষ্ট দেয়।।।
আমি চোখের পানিটা মুছে ফেল্লাম।।। আর রাকিব বল্লাম, "ভালো থেকো রাকিব।।।""" তার সামনে আমার আর কিছুই বলার ছিলো না।।। পাভেল আমার হাতটা শক্ত কররে ধরলো।।।
রাকিবের সামনে থেকে এভাবেই বিদায় নিলাম।।। ছয় মাসটা আমাদের জন্য ছয় বছর ছিলো।।। আজ যখন তার সামনে এসেছি কান্নার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দই ছিলো না আমার।।।। পাভেল একটা কথা ই বলেছিলাম, "আমি শুধু রাকিবকেই ভালোবাসি!!! ও ছাড়া ভালোবাসা শব্দে আমি আর কাউকে পাই না।।।

পাভেল: আমি জানি।।। আর বুঝতেও পেরেছি।।। সমস্যা হবে না।।।।
আজ আমার বিয়ের বয়স এক বছর তিন মাস চলছে।।। এই সময়টায় অনেক কিছু পেয়েছি আবার যা হারিয়েছি তার ক্ষত আজও শুকায় নি।।। তবে পাভেল নামের ছেলেটা সে ক্ষত শুকানোর জন্য বরাবর মলম দিয়ে গিয়েছে।।। হ্যা, পাভেল নামের ছেলেটার সাথেই আমার বিয়ে হয়েছে।।।
আমার আজও মনে আছে সে বিয়ের রাতের কথা, যখন আমি "কবুল" শব্দটি উচ্চারন করতে যাই তখন আমার ঠোঁট কাঁপছিলো।।। চোখের কোনা দিয়ে শুধু পানি পড়ে যাচ্ছিল।।। আম্মু শক্ত করে হাত ধরে ছিলো।।।
চোখে ছিলো রাকিবের চেহারা আর শরীরে ছিলো আম্মুর স্পর্শ।। উভয়ের মিশ্রণে আমি কেমন জানি তালগোল পাকিয়ে ফেলছিলাম তখন পাভেল আসে রুমে।।
পাভেল রুমে এসে একটা কথাই বলেছিলো, """"আমি রাকিব হতে পারবো না ইভেন চাই ও না তবে রাকিবের মতো যত্ন করে রাখবো আপনাকে।।। আমি ভালোবাসা দিয়ে রাকিবের জায়গা মুছে দিবো না আপনার মন থেকে, তবে আপনার প্রতি দায়িত্ববোধ আর আন্তরিকতা দিয়ে আপনার মনে আমার জায়গা করে নিবো আর সে সুযোগটা তো দিতে পারেন।।।""""
জানেন, পাভেল সেদিন ভুল বলে নি।।। সে রাকিবকে নিয়ে কখনও কোন অভিযোগ করে নি।।। এমন কি পাভেল আজও বলে, """"আপনার ভালোবাসাকে আমি শ্রদ্ধা জানাই।।।""""
যেদিন প্রথম পাভেলকে দেখি সেদিন মনে হয়েছিলো, পাভেলের শুধু টাকা পয়সা ই আছে আর তা সে তার গেটআপে প্রকাশ করে আর এবং 'তার মন' তার টাকা পয়সা, গেটআপ সবকিছুর মাঝ থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে।।। কিন্ত সেদিন আমি ভুল ছিলাম।।। পাভেলের মতো ছেলে হাজারটা পূর্ণ্য(ভালো কাজ) করা ফলেও পাওয়া যায় কি না সন্দেহ আছে।।।
ছেলেটাকে আমি আজ অব্দি কিছুই দিতে পারি নি কিন্তু সে আমাকে কোন ক্ষেত্রেই কোন কিছু থেকে বঞ্চিত হতে দেয় নি।।। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আন্তরিকতা সবকিছুতেই পরিপূর্ণ রেখেছে।।।
পাভেলের পরিবারে লোকজন অনেক সময় আফসোস করে আমার সন্তানের জন্য কিন্তু পাভেল তাদেরকে বুঝতে দেয় নি যে সন্তানহীন থাকার পেছনে দোষটা আমারই।। বরং পাভেল প্রতিনিয়ত বলে, সে বাবা হতে চায় না।।। বাচ্চা কাচ্চা তার অপছন্দ।।।
পাভেলের মা মাঝে মাঝে অভিযোগ করে, আমি পাভেলের পছন্দকে গুরুত্ব দি না।।। কিন্তু পাভেল ছেলেটা খুব জোরে আওয়াজ করে হাসি দিয়ে তার মাকে একটা কথাই বলে, """মা নীরার সবকিছু ই তো আমার পছন্দ।। ও কোন কাজে আমার পছন্দ ছাড়া আমি অপছন্দ খুঁজে পাই না।।।""""
কিন্তু আমি বুঝি, পাভেল এ কথা বলে তার মনের মাঝে থাকা হতাশার ঝড়টাকে দমিয়ে রাখে।।।
আমি আজ অব্দি পাভেলের পছন্দের কিছু করতে পারি নি,  এমন কি আমার বিয়ের দিন ও আমি নিজেকে রাকিবের পছন্দ মতো সাজিয়েছি।।। রাকিবের পছন্দের রঙ্গ, ব্লাউজের ডিজাইন, পায়ে আলতা, লাল বড় টিপ সবকিছুতে রাঙ্গিয়েছি নিজেকে কিন্তু তাতেও পাভেলের কোন অভিযোগ ছিলো না।। শুধু একটা কথাই পাভেল বলেছিলো, """আপনাকে খুবই সুন্দর লাগছে।।।। রাকিব ভাইয়ের চয়েস ভালো ছিলো।।। যাক, আমাদের ফটো সুন্দর আসবে।।।""""
কিন্তু আজ পাভেলের পছন্দ মতো রান্না করেছি।।। সুজি পিঠাকে দুধ দিয়ে রান্না হচ্ছে পাভেলের পছন্দের আইটেম আর আজ তা ই করলাম।।।  প্রথম তার জন্য কিছু করলাম কেন জানি খুব শান্তি লাগছে।।।

আচ্ছা আমি তো মানুষটাকে ভালোবাসি না, তার প্রতি কোন আবেগ ও নেই আমার, মায়া ও কাজ করে না তবে কেনো তার জন্য কিছু করতে পেরে এতটা ভালো লাগছে।।।
পাভেল খাবার টেবিলে যখন দেখলো তার জন্য সুজি পিঠা রান্না করছি তখন সে আমাকে একটা কথাই বললো, "আচ্ছা, রাকিব ভাইয়েরও কি সুজি পিঠা পছন্দ!!! বাহ!!!! আমার সাথে উনার পছন্দের মিল আছে।।।""""
আমার তখন খুব বলতে ইচ্ছা করেছিলো, "নাহ! এটা আমি আপনার জন্য করেছি।।। কেনো সবসময় যা করবো তা রাকিবের জন্য ই করতে হবে, আপনার জন্য কি কিছু করতে পারি না!!!!""""
কিন্তু কেনো জানি কথাটি বলতে আমি পারি নি।।।
পাভেলের আজকে জন্মদিন কিন্তু আমি উনাকে উইশ ও করি নি।।। আসলে আমি জানতাম না।।। আমার তারিখটা মনে থাকে না।।।
হঠাৎ পাভেল রুমে আসে।।।
পাভেল: আপনার কি মন খারাপ????
আমি: নাহ তো।।। কেনো???
পাভেল: আসলে মনে হলো চিন্তা করছেন।।। আচ্ছা আজকে কি আপনার কোন কাজ আছে???
আমি: নাহ তো।। খাওয়া দাওয়া আর ঘুম ছাড়া তো আমার কোন কাজ থাকে না।।। যদিও এই পরিবারে থাকি আমি তবে এই পরিবারের জন্য কিছু করতে হয় না।।।
পাভেল: এভাবে কেনো বলছেন???
আমি: ঠিক ই তো বল্লাম।।। আপনি আমাকে একবার বলেছিলেন, আমি খুব ভাগ্যবতী।।। আসলেই আমি ভাগ্যবতী।। বউ হতে পারি নি তবে খুব ভালো শশুড় বাড়ী পেয়েছি।।।
পাভেল: আপনি কি যা তা বলছেন।।। মাথা ঠিক আছে আপনার!!! আচ্ছা বাদ দেন।।। একটা অনুরোধ করি রাখবেন???
আমি: অবশ্যই।।। করলে খুব খুশি হবো।।।
পাভেল: আমি আর আপনি কি কোথাও ঘুরতে যেতে পারি।।। মানে আজ ডিনার টা বাইরে করলাম!!!!
আমি: হুম অবশ্যই।। আজ তো আপনার বার্থ ডে তো অবশ্যই যাওয়া যায়।।।
দুইজনই চুপচাপ টেবিলের এ মাথায় আর ও মাথায় রেস্টুরেন্টে বসে আছি।।। তার সামনে বসে থাকতে আজ জড়তা কিংবা বিরক্ত কাজ করছে না বরং ভালোই লাগছে।।।
পাভেল: আপনি আর রাকিব ভাই বেশিরভাগ সময় এই রেস্টুরেন্টে আসতেন, তাই না???
আমি: হুম কিন্তু আপনি কিভাবে জানেন???
পাভেল: আপনার চোখে মুখে আনন্দের ছায়া দেখলে বুঝতে পারি।।।
আমি: আপনি বোধ হয় একটু বেশি বুঝেন!!!
পাভেল: আর আপনি একদমই বুঝেন না।।।
আমি: আরেকটু সময় দেন বুঝে নিবো।।।
পাভেল: থাক আমাকে বুঝতে হবে না বরং সুপ খান আপনার অনেক পছন্দ।।
আজ হঠাৎ সুরাইয়ার(আমার বান্ধবী) সাথে দেখা।। মেয়েটার সাথে তিন বছর পর দেখা হয়েছে।।।
কুশল বিনিময়ের পর,
সুরাইয়া: তোর সাথে কে উনি???
আমি: আমার জামাই।। নাম পাভেল।।। (ওকে কথাটা বলতে কেমন জানি জড়তা কাজ করেছিলো তবে ভালো ও লেগেছিলো)
কিছুক্ষন পর পাভেল দেখি নিজে একা একাই হাসছে।।।
আমি: এভাবে হাসার মানে টা কি???
পাভেল: ভালো লাগছে।।।
আমি: কি???
পাভেল: আমার নামের আগে "জামাই" শব্দ দিয়ে একটা বিশেষন তো দিলেন।।।
আমি: সত্য কথা ই তো বল্লাম।।।
পাভেল: হুম তা ঠিক।।। আসলে, কিছু সত্য মনে ভীষন আনন্দ দেয়।।। আচ্ছা চলেন, বাসার দিকে যাওয়া যাক।।

আজকের আবহাওয়া দেখে ইচ্ছা করলো পাভেলকে বলি, "চলুন, আমরা আজ রিকশায় ঘুরি।।।।"
কিন্তু বলতে পারি নি।।। আকাশে চাঁদ দেখলেই কেনো জানি রাকিবের কথা মনে হয়।।। চাঁদকে ঘিরে আমার আর রাকিবের অনেক স্মৃতি আমাকে আজও জড়িয়ে রেখেছে।।। আচ্ছা, রাকিব ওপারে ভালো আছে তো।।  ও কি আমাকে ওপার থেকে দেখছে।।।
জানেন, এই দেড় বছরে প্রতিটা রাতেই রাকিবকে আকাশের নক্ষত্রের মাঝে খুঁজেছি আমি।।।
ছোট বেলায় আম্মু বলতো, "তোর বাবা ঔ দুর আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটা" তখন বিশ্বাস করতাম আর খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতাম।। যদিও বড় হতে হতে বুঝতে পারি, কথাটা শান্তনামুলক একটা বাক্য ছিলো কিন্তু তাও রাকিবকে খুঁজি, খানিক সময়ের জন্য মনে হয় ও আমার পাশে আছে।।।
সেদিন যখন রাকিবের সাথে শেষ দেখা করি, তখন রাকিব কোন কথা বলে নি বরং চোখ বন্ধ করে সাদা কাপড়ের নিচে ঘুমিয়ে ছিলো।।।
রাকিবের অস্তিত্ব ছিলো তবে আত্মাহীন অস্তিত্ব।।।
জানেন, আজও সেদিনের কথা মনে পড়লে, মনের মাঝে কেমন জানি হাহাকার করে উঠে।।।
সেদিন রাকিব আমার সাথে কোন কথা বলে নি কিন্তু ওর কথার ঝুড়ি রেখে গিয়েছে আমার কাছে।।।
রাকিব একটা চিঠি দিয়ে গিয়েছিলো।।। ও যখন হসপিটালের বেডে জীবনের শেষ কিছু ঘন্টা নিয়ে ছিলো তখন ও আমার জন্য চিঠিটা লিখে গিয়েছিলো।।।
হঠাৎ পাভেল বলে উঠলো,"নীরা, বাসায় চলে এসেছি।।। নামবেন না???
আমি: হুম।।।
পাভেল: মন খারাপ করে দিলাম নাকি???
আমি: নাহ তো।।।
রুমে ঢুকেই সবার আগে রাকিবের দেয়া চিঠিটা খুঁজে বের করি।।।।
ভালোবাসা,
আমি জানি, তোমার শেষ নিশ্বাসের অংশ হয়ে ছিলাম আমি কিন্তু আমি চাই না, ভবিষ্যতে থাকতে।।। 'তোমাকে আমি' আর 'তুমি আমাকে' অনেক ভালোবেসেছি এটা যেমন সত্য কথা, তার চেয়ে বহুগুণ সত্য হচ্ছে আজকের পর থেকে আমি তোমার অতীতে রুপ নিবো।।
আমি জানি, সত্যটা তোমার মেনে নিতে কষ্ট হবে কিন্তু সৃষ্টিকর্তা এটাই চায়।।।
আমি জানতাম, আমার হাতে সময় খুব কম আর যা গত বছর ১৪ই ফেব্রুয়ারিতেই বুঝতে পেরেছিলাম।। কিন্তু এই কম সময়ের প্রতিশ্রুতিতে সৃষ্টিকর্তা আমাকে এতটা সময় দিবে বুঝতে পারি নি।।। জানো, ভালোবাসা দিবসে তোমার সাথে দেখা করা শেষে আমি বাসায় যাই নি বরং ডাক্তারের কাছে মাক্স হসপিটালে গিয়েছিলাম, আমার রিপোর্ট দেখাতে।।।
ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা কথাই বলেছিলো, "Rakib you are  adult enough, so you have to know your condition.... You just get one year to see your parentz, family, your  lover and the light of this world, PlZ Rakib fulfill all your wishes....."

আমি একটা কথাই বলেছিলাম, "স্যার কোন রোগটা আমাকে শেষ করেছে???"""
ডাক্তার: তোমার লিভারে সমস্যা??
আমি: কি হয়েছে???
ডাক্তার: ক্যান্সার।।। আর লাস্ট স্টেজে আছে।।।
আমি: কতদিন পাবো হাতে??
ডাক্তার: ১বছর।।
জানো, ডাক্তারের মুখে এক বছর শুনতে পেয়ে ভীষন খুশি হয়েছিলাম।।।
চিন্তা করেছিলাম, তোমাকে বিয়ে করবো।।। একটা জুনিয়র নীরা হবে আমাদের।।। আর ওর নাম রাখবে "কিরণ", যেনো জুনিয়র নীরা তোমার অন্ধকার জীবনে আলোর স্পর্শ নিয়ে আসে।।। আর যদি জুনিয়র রাকিব হয় তাহলে রাখবো "আনন্দ" যেনো ও তোমার জীবনটা আনন্দে ভরপুর করে দেয়।।।
সেদিন যখন এ কথাগুলা চিন্তা করেছিলাম তখন নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয়েছে।।। নিজের বিবেক একটা কথাই বলতে ছিলো, "রাকিব ভালোবাসাকে স্বার্থের কাছে হেরে জিতে দিও না।।।""
তখন তোমার আম্মুকে কল দি আর আন্টিকে অনুরোধ করি যেনো আমার সাথে দশ মিনিটের জন্য দেখা করে।।। তারপর আন্টির সাথে দেখা করি, আর আন্টিকে আমার হাতে থাকা এক বছরের কথা বলি।।। আন্টিকে বলি যেনো উনি তোমাকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়।।। সেদিন আন্টি আমার কথানুযায়ী ই তোমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিয়েছিলো।।।

জানো, পাভেলের সাথে তোমার বিয়ের কথাটা আমি তোমার আগেই জানতাম।।। আমি জানতাম, সেদিন আড়ং-এ তোমাকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে।।। আর তাই তোমাদেরকে দেখতে গিয়েছিলাম।। দুজনকে একসাথে কিন্তু ভীষন সুন্দর মানিয়েছে।। পান্জাবী সেদিন একটা অজুহাত ছিলো।।। যেনো তুমি প্রশ্ন করতে না পারো, কেনো আমি আড়ং-এ গিয়েছি।।।
তুমি বলছিলে, পাভেলের খোঁজ খবর নিতে আর আমি তা অনেক আগেই নিয়েছিলাম।।। তবে বিয়ে ভাঙ্গার জন্য নয় বরং তোমাকে বিয়ে দেয়া যায় কি না তা দেখার জন্য।।।
সেদিন যখন পাভেলের পরিবার তোমাকে পছন্দ করেছিলো, সে সন্ধ্যায় আমি পাভেলের সাথে দেখা করতে যাই এবং তাকে আমাদের সম্পর্কের কথা বলেছিলাম।।। তাকে বলেছিলাম, "ঘড়ির কাঁটায় আমার সময় খুব কম"""
জানো, পাভেল ছেলেটা ভীষণ ভালো।। অন্য কেউ ওর জায়গায় হলে হয়তো প্রাক্তন প্রেমিকের মুখে নিজের হবু বউয়ের কথা মেনে নিতে পারতো না কিন্তু পাভেল সব শুনেছে এবং হাসিমুখে মেনে নিয়েছে।।।
ইরফানকে বলে গিয়েছে, তোমার খেয়াল রাখতে।।। ছেলেটা তোমাকে বরাবরের মতোই ছোট বোনের মতো খেয়াল রাখবে।।।
আর, পাভেল যেনো আমার জানাযায় উপস্থিত থাকে।।। নীরা, তোমার জামাইকে এই অনুরোধটা করিও।।।

আর হ্যা, আমার চিঠি পড়ে চোখের পানি ফেলার কিছু নাই।।। তুমি এত দিন জামাই পাইতা তবে শ্বশুরবাড়ি পাইতা না।। কিন্তু আজ ভালো জামাই, শ্বশুরবাড়ি সব পাবা এবং জুনিয়র রাকিবের পরিবর্তে জুনিয়র পাভেল পাবা।।।
শোনো না, যেদিন তোমার পাভেলকে বিন্দু পরিমান আপন মনে হবে সেদিন আমার এই চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দিও।।। আমি চাই না, তোমাদের অস্তিত্বের মাঝে আর কেউ আসুক।।। প্লিজ নীরা ভালোবাসার মানুষের এই অনুরোধটা রাখিও।।।।
এটা ছিলো রাকিবের শেষ সম্পদ আমার জন্য।।। মাঝে মাঝে চিন্তা করি, সৃষ্টি কর্তা কেনো আমার ভালোবাসার এভাবে পরীক্ষা নিলেন!!! কেনো পাভেলের ধৈর্য্য, ভালোবাসার পরীক্ষা নিচ্ছে????
নাহ!! পাভেল কে আর কষ্ট দেয়া যায় না।।। আমাকে হার মানতেই হবে পাভেলের ভালোবাসার কাছে।।।।
রাকিবের দেয়া চিঠিটা আজ ছিঁড়ে ফেলে দিলাম।।।
আর চিন্তা করলাম, আজ নিজেকে বিলীন করে দিবো পাভেলের কাছে।।। পাভেল রুমে আসার আগেই তার দেয়া গোলাপী রঙ্গের মসলিন শাড়ীটা পড়ি।।। নিজেকে আজ সর্বোচ্চ সুন্দর করে সাজিয়ে পাভেলের রঙ্গে নিজেকে রাঙ্গানোর চেষ্টা করি।।। পাভেল রুমে ডুকে খানিকটা অবাক হলো।।। বলা যায়, আকাশ থেকে পড়লো।।।।
পাভেল: আপনাকে ভয়াবহ সুন্দর লাগছে।।। মাঝরাতে হঠাৎ এতো সুন্দর করে সাজার কারনটা কি????

আমি: কেনো, মাঝরাতে সাজলে কি গুনাহ হবে নাকি???
পাভেল: আরে আমি এটা বোঝাই নি।।। বরং এতো ভয়াবহ ভাবে সাজলে তো আমি আপনার প্রেমে পড়ে যাবো।।।
আমি: আমি তো তা ই চাই।।। দেখেন, এই দেড় বছরে যা হারিয়েছি তার চেয়ে বহুগুণ পেয়ছি।। কিন্তু হারানোর শোকে আমি পারি নি আমার প্রাপ্তির আনন্দে মেতে উঠতে।।। তাই আমি চাই, আজ থেকে বরং এখন থেকে আমার অতীত ভুলতে।। আপনি কি আমাকে হাত বাড়িয়ে আপন করে নিবেন??? (কথা গুলো বলতে আজ দ্বিধা বোধ হয় নি।। জড়তাও কাজ করে নি।। কিছুক্ষনের জন্য তো ভুলে গিয়েছিলাম রাকিবের কথা)))
পাভেল: আপনি এভাবে বলতে হবে না।।। আমি সবসময় আপনাকে আমার অস্তিত্বের অংশ মনে করতাম এবং অনেক বেশি ভালোবাসি।।।
পাভেল যখন কথাটা বলে আমার হাত ধরলো আর কপালে চুমু খেলো, তখন তার ঠোঁটের কোমল স্পর্শে আর তার শক্ত হাতের স্পর্শটা আমার মাঝে কেমন জানি পূর্ণতা নিয়ে এসেছে।।। আসলেই, আমি আজ বোধ হয়, তাকে আপন করে নিতে পেরেছি।।।
ভালবাসাহীন সম্পর্কের মাঝে থাকে দায়িত্ববোধ, আন্তরিকতা,শ্রদ্ধা।।। আর এসব কিছু পারে হাজারটা ভালোবাসার গল্প জন্ম দিতে।

No comments