গাছের ছায়ায় ঘুম | আকবর হোসেন রবিন


আমাদের বাড়িতে ছোট-বড় দুইটা পুকুর আছে। ছোট পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে কবরস্থান। অন্য তিন পাড়ে বড় গাছ খুব একটা না থাকলেও দক্ষিণ পাড়ে অর্থাৎ কবরস্থানে কিছু বড় বড় গাছ সবসময় থাকে। সেজন্য কবরস্থানে সর্বদা গাছের ছায়া পড়ে। পুকুর পাড়ের এই করবস্থান দেখতে অনেক সুন্দর। শুধু আমাদের বাড়ির করবস্থান না, যেকোন বাড়ির পুকুর পাড়ের কবরস্থান গুলো খুব সাজানো-গোছানো থাকে, দেখতে সুন্দর হয়। 

যারা গ্রামে মারা যায় তাদের অনেক সৌভাগ্য। গাছের ছায়ায় যুগের পর যুগ নিরন্তর ঘুমাতে পারে। মন চাইলে পাশের কবরে শুয়ে থাকা প্রিয়জনদের ডেকে গল্প শোনাতে পারে। শুয়ে শুয়ে পুকুরের পানির তরঙ্গ উপভোগ করতে পারে। মাছরাঙ্গার চুপচাপ বসে থাকা কিংবা শূন্যে ডানা ঝাপটিয়ে ঝপাত করে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ শিকারের দৃশ্যও দেখতে পারে। নামাজ শেষে বাড়ির ছেলেপেলে ময়মুরুব্বিরা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া পড়ে, চোখ ভেজায়; কবরে শুয়ে থাকা ব্যক্তিরা এসব নীরবে দেখতে পারে। বুঝতে পারে কিছু মানুষ মৃত্যুর অনেক বছর পরেও তাদের শূন্যতা অনুভব করে, খুব ভালোবাসে। 

কিন্তু, শহরে করবগুলো কেমন যেন কৃত্রিমভাবে তৈরি। পাশে পুকুর নেই, গাছের ছায়া নেই, গল্প করার জন্য পরিচিত কোন মানুষ নেই। পাশে শুয়ে থাকা মানুষগুলো কেউ হয়তো উত্তরবঙ্গের কেউ হয়তো দক্ষিণবঙ্গের, এতে সমস্যা পোহাতে হয় ইনট্রোভাটদের। 

সেদিন আমি দুই ইনট্রোভাট ছোট ভাইকে নিয়ে সাগর পাড় যাচ্ছিলাম। যেতে যেতে হঠাৎ এক জায়গায় একটা গাছের দিকে চোখ পড়তেই আমার দৃষ্টি আটকে গেল। ত্রিকোণাকৃতি একটা মাছের ঘের। তার পাশে কিছুটা কাত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাঝারি সাইজের নাম-না-জানা একটা গাছ। ঘের ও গাছ মিলে ওই জায়গাটা ভীষণ সুন্দর। আমার মনে হলো এই গাছের নিচে একটা কবর হলে মন্দ হয় না! মৃত ব্যক্তি আরামসে শত শত বছর শুয়ে থাকতে পারবে।

খুব ইচ্ছে করছিলো গিয়ে গাছের তলে ঘাসের উপর কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি। কিন্তু ঘেরের চারপাশে কাটা তারের বেড়া থাকায় তা আর সম্ভব হয় নি। আমার পাশে থাকা ছোট ভাইদের গাছটার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম, ‘দেখ, কবরের জন্য এটা একদম পারফেক্ট একটা জায়গা। তাই না?’ আমার কথা শুনে ওরা খানিকটা চুপসে গেল। আমি ওদের চেহারায় বিরক্তি ও ভয়ের মিশ্র অনুভূতির ছাপ দেখতে পেলাম। আচ্ছা মৃত্যুকে মানুষ এত ভয় করে কেন? করবস্থান দেখলেও অনেকে ভয়ে কাঁপে।কবরস্থানের পাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় নাকি অনেকের গা ছম-ছম করে উঠে। কিন্তু কই আমিতো কখনো এমন ভয় কিংবা গা ছম-ছম অনুভব করি নি! অথচ বাড়ির কবরস্থানের পাশ দিয়ে রাত-বিরাতে কত হেঁটেছি! 

             ছবি: আলফে শাহারিন

আমার দাদিও অনেক হাঁটতেন। কবরস্থানের পাশ দিয়ে হেটে হেটে জঙ্গলে যেতেন ঢেঁকি শাক খুঁজতে। ঢেঁকি শাক দাদির খুব পছন্দের খাবার ছিলো। প্রায় এক সপ্তাহ পর পর উনি শাক খুঁজতে বের হতেন। কবরস্থানের পাশ দিয়ে হেটে যেতেন। কিন্তু দাদি এখন আর হাটতে পারে না। কবরে শুয়ে শুয়ে শুধু দেখে, কবরস্থানে দুইটা গাছে ঝুলে আছে ঢেঁকি শাক, সেগুলো ধীরে ধীরে বড় হয়ে শক্ত হয়ে যাচ্ছে। কবরের উপরে এসে ছায়া দিচ্ছে। মাছরাঙা ঠোঁটে করে মাছ নিয়ে এসে গাছের ডালে বসছে। অর্ধেক মাছ খাচ্ছে বাকি অর্ধেক মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। বর্ষার শুরুতে পুকুর থেকে কিছু কৈ মাছ পাড় বেয়ে উঠে আসে কবরে। দাদি কৈ মাছ ভাজি খেতে খুব পছন্দ করতেন, এটা কি মাছরা জানে?




No comments