অদৃশ্যমান | মুহাম্মদ নূর ইসলাম হৃদয়
হোম কোয়ারেন্টাইনের ২৭তম দিনে এসে রিয়াদের একটু চিন্তা শুরু হলো। কি করবে, কিভাবে চলবে বাকি দিন গুলো। এই অসুস্থ বাবা, মা আর বোন'কে নিয়ে আর ক'দিন চলতে পারবে।
হিসেব কষে বের করলো মোটে আর ৫ কি ৬ দিনের খাবার মজুদ আছে। তারপর? কিচ্ছু ভাবতে পারে না সে।কিইবা করার আছে আর তার। এমন পরিস্থিতির মুখে পরতে হবে সে কখনো কল্পনাও করেনি। কত কিছু নিয়েই না তার পরিকল্পনা ছিলো!
দুটো টিউশন করাতো। নিজে চলতো, ফ্যামিলিকেও টুকটাক দিতো যা পারতো। সে ভেবেছিলো এই বছরটার মধ্যেই বাবার সমস্ত ঋণের কিছুটা হলেও সে শোধ করে দিতে পারবে।
যেমন পরিকল্পনা, তেমন উদ্যমেই শুরু করেছিলো সব। কিন্তু বাধ সাধলো এই করোনা ভাইরাস। এতো এতো বাধা বিপত্তি অথবা মানসিক চাপেও যে দমে যায় নি, সে আজ বাধ্য হয়ে চার দেয়ালের মধ্যে বসে আছে।
কি জীবন!
জীবনের ধাক্কা এবার সে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার হওয়া যে পাপ, সেটা আগে তাকে কেউ বলেনি। যদি বলতো, তাহলে এখন এতো কষ্ট লাগতো না। নিজেকে সামলে নিতে পারতো। কিন্তু এখন পারছে না। কেউ তো তাকে এসে ভিক্ষে দিয়েও যেতে পারছে না!
এতোদিন ধরে যে সম্মানে সে চলেছে, তা মনে হচ্ছে তার বুকে বর্শার মতো বিঁধে ফালা ফালা করে দিয়ে যাচ্ছে।এখন না পারছে সম্মান বাঁচাতে, না পারছে ভিক্ষে করতে।
অথচ শুরুর দিকে, এমনটা হবে কল্পনাই করেনি কেউ। সেও ভেবেছিলো দ্রুতই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। হয়তো একটু পিছিয়ে গ্যালো, এই যা। কিন্তু না। একটু না। তার মনে হচ্ছে সে তার লক্ষ্য থেকে যোজন যোজন দূর পিছিয়ে যাচ্ছে। এখন আর তার লক্ষ্যের কথা মাথায় আসছে না। এখন মাথায় আসছে বেঁচে থাকার কথা। পরিবার কে বাঁচিয়ে রাখার কথা।
বাবা অনেক আগে থেকেই বাসায় বসা। যা কিছু করতো, তাতে ভাগ বসাতো ঋণের সুদ কিংবা কিস্তি। আর তার মা জীবনের প্রায় সবক'টা বছরই চার দেয়াল দেখতে দেখতে কাটিয়ে ফেলেছে। কোনোদিন ও মুখ ফুটে কিছু চায়নি, বলেও নি। শত ব্যথা কিংবা অসুস্থতা নিয়েও করে গেছে নিজের সবটা দিয়ে।
বোনটা জন্মের পর থেকে সুখ বলে কিছু দেখেনি। অথচ রিয়াদের জন্মই হয়েছিলো রীতিমতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে। কষ্ট কাকে বলে সে বুঝতো না। নাই, শব্দটা সে কক্ষনো শোনে নাই। আজকে যখন তার বাবা এসে, অনেক ভনিতা করার পর তার কাছে ২০ টাকা চাইলো। তখন সে বুঝতে পারলো সে কতটা অসহায়।
হটাৎ করেই তার মনে হতে লাগলো সে'ই যেনো এখন এই পরিবারের সর্বেসর্বা। যে বাবা'র মুখের দিকে কথা বলার সাহস তার কক্ষনো হয় নি, তার এহেন সমীহ করা চেহারা, সে মানতেই পারছে না।
চিরকাল আদরে আর ভয়ে থাকা একটা ছেলেটা কখন যে এতোটা নির্ভরতার জায়গা হয়ে উঠবে, তা নিয়ে কি আদৌ কেউ ভাবতে পেরেছিলো? অথচ আজ পুরো তিনটে পেট যেনো তার দিকে তাকিয়ে আছে!
সংক্রমণের প্রথম দিকটায় সে আসলেই অতটা ভাবেনি। বরং দিন মজুর, খেটে খাওয়া মানুষ, যারা প্রথমেই হাত পা ভেঙ্গে ঘরে বসেছিলো, তাদের সাহায্যে সে ও তার যৎসামান্য সামর্থ্য আর প্রবল ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে গেছিলো।
কিন্তু আজ সে বুঝতে পারছে; যাদের সৃষ্টিকর্তা সম্মান আর অভাব দুটোই এক সাথে দিয়েছেন, তারা কতটা একা!
রিয়াদের আগের কিছু জমানো টাকা ছিলো। এখন সবটা শেষের পথে।
শুনেছে বিভিন্ন সংগঠন থেকেও নাকি সাহায্য সহযোগিতা করছে। কিন্তু যে ছেলে নিজেই সাহায্য সহযোগিতা করে বেরিয়েছে এদ্দিন, সে কিভাবে আজ হাত পাতে?
সম্মান দেয়ার চাইতে মরে যাওয়াও ভালো, এই কথাটা বারবার মাথায় এসে ঢু মারছে। শুনেছে সরকার ও নাকি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু ত্রান সহযোগিতার নাম্বারে ফোন দিলে আদৌ কিছু হবে কিনা, সে আস্থা সে খুঁজে পাচ্ছে না। দেশের সরকার ব্যবস্থার প্রতি আগে থেকেই যার বিশ্বাস উঠে গেছে, এই দূর্যোগের সময়ে সেও কিভাবে বিশ্বাস করতে চাইছে!
সে গতকাল শুনেছে, সময় মতো চিকিৎসার অভাবে একজন ডাক্তার ও নাকি মারা গেছেন৷ এই বিপদের সময়ে যারা অগ্রপথিক হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা লড়ে যাচ্ছে, তাদের এই করুণ মৃত্যু দেখে রিয়াদের মাথা থেকে মৃত্যু ভয়টা আরো ঘিরে ধরছে।
কিন্তু কি করবে সে? কোথায় যাবে? ৫/৬ দিন চলার পর আর ক'দিন তারা বাঁচতে পারবে? তার স্বপ্ন গুলো পূরণ হবে তো? যে বাবা-মা তাকে এতো দূর টেনে নিয়ে এসেছে, তাদের মুখে কি সে হাসি ফোটাতে পারবে না? যে বোনটার চোখের জলের বিনিময়ে নিজের প্রাণ দিয়ে দিতে পারে, তার জন্যে কি তার কিছুই করার নাই?
তার এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, কোনো দৈববলে সে যদি সরকার হয়ে যেতে পারতো। তাহলে যাদের পা ধরে ভোট ভিক্ষে করেছে, তাদের পা ধরেই এক সাথে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়ে আসতো। তার ভাবতে কষ্ট হয়, সব কিছু অযোগ্য দের হাতে চলতে থাকলে, এই দেশের একটা মানুষ ও কি বাঁচবে?
হুকুমের ওপর ও যদি হুকুম থাকে। মানুষের পেটের ক্ষুধা দেখে, এখনো কেউ কি হুকুমের গোলামী করে যাবে?
এই চরম কষ্টকর মুহূর্তেও এমন উদ্ভট, অসম্ভব, হাস্যকর আর ছেলেমানুষি চিন্তাভাবনা করছে ভেবে সে খানিক্ষন হেসেও নিলো। অযোগ্যতায় ভরা জায়গাটায় আবার যোগ্যতার প্রশ্নও সে তুলছে ক্যামন করে!
আবার ভাবতে থাকে সে; তারা কি আবার স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে? এই ছোট ছোট আশা গুলোকে ভর করে যে তাদের নিত্যকার বেঁচে থাকা, সব কি শেষ হয়ে যাবে?
রিয়াদের চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। যন্ত্রণা, আক্ষেপ আর উৎকন্ঠা মিলিয়ে সে যেনো ধীরে ধীরে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করলেই তিনটে করুণ চেহারা সে দেখতে পাচ্ছে।
তার মনে হচ্ছে, খাবারের প্রতি দানার সাথে সাথে, সে আরো তিনটে মানুষের আয়ু গিলে খাচ্ছে।
কতই বা তার বয়েস? ২১ ছুঁই ছুঁই। এটুকু বয়েসে যেখানে জীবনের রঙে রঙিন হয়ে ছুটে বেড়ানোর কথা, সেখানে সে কতগুলো জীবনের ভার বয়ে নিয়ে চলেছে! এভাবে আর কতদিন সয়ে থাকা যায়। যারা কখনো সম্মান আর ক্ষুধার চাপ এক সাথে চোখে দেখেনি, নিম্নমধ্যবিত্তের আর্তচিৎকার তারা কি আদৌ বুঝবে? তার চোখে ফুটে ওঠে প্রিয়জন হারানোর ভয়। এক অসহায়ত্বে ভর করে সে প্রতি নিয়ত নিজের কাছে হেরে যেতে থাকে।
তার সামনে হয়তো এতোদিন ধরে টিকে থাকার লড়াই'টা একবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তবুও জীবনের শেষ অব্দি সসম্মানে বেঁচে থাকার এক প্রবল ইচ্ছায় নিজের মন'কে শক্ত করতে থাকে সে। হয়তো শেষ অব্দি কাউকে মুখ ফুটে কিছুই বলবে না। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে সে কারো কাছেই হাত পাতবে না। সে শুধু জানে সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ করা ছাড়া তার এই দুটো হাতের আর কিছুই করার নাই।
অদৃশ্যমান এক ক্ষমতার কাছে পরাজয়ের অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে সে।
ma boi nururidoy
ReplyDelete