সুখের মাজেজা ও তাসনিম রিফাতের বিশ্লেষণ
সুখ | প্রীতম ঘুম
আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপ করে। ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে দুই যুবক যুবতী। শাড়ি পরেছে মেয়েটা, আর ছেলেটা তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। গলায় একটা চুমু খেলো। মেয়েটা হাসছে। বোঝা যায় নতুন বিয়ে হয়েছে তাদের, হানিমুন ফেইজ এখনো যায় নি।
মেয়েটা মিটমিট করে হাসে। হঠাৎ চোখ বুজে ছেলেটাকে বলে, তুমি কি খুন করবে না আমাকে!
এত তাড়া কিসের? ছেলেটা চোখ মটকায়।
এরপর বলে, তুমি এত লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছো যে!
এরপর বলে, তুমি এত লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছো যে!
-ছোট মামী ফোন করেছিলো। সব শুনে মুখ বেঁকিয়ে বলল, ঢঙের কী ছিরি! এখনই নাকি উপযুক্ত সময়।
-তোমার ছোট মামি বেঁচে আছেন এখনও!
-ওহ, ওটা? ওটা তো বড় মামীর ব্যাপারে বলেছিলাম।
-ও আচ্ছা।
-আমি বুঝি ছোট মামী অসুখী। কিন্তু খুব বিরক্তিকর উনি। সবার উপর গজগজ করাটা উনার স্বভাব।
-হয়ত নিজে হন নি তাই। হয়ত কারো বাসায় কোন হাসিমুখ দেখে খারাপ লেগেছে তার।
-হ্যাঁ। মেয়েটা বলে।
হঠাৎ দুজনেই চুপচাপ হয়ে যায়।
ছেলেটা একটু পর বলে, ভালো শোকেজ নেই আমাদের!
মেয়েটা জবাব দেয়, শোকেজ নিয়ে এত চিন্তা কেন তোমার? ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়!
রাতে খাবার সময়ে মেয়েটা বলে, ফোন করেছিলাম দোকানে। শোকেজ আনিয়েছি!
-কোথায়?
-কোথায়?
-আছে ড্রয়িং রুমেই। এটার ভিতরে লাইট আছে। জ্বালালে এত সুন্দর লাগে!
-এত খরচ করলে?
-একটাই শোকেজ হবে আমাদের। করবো না!
ছেলেটা এবার কিছু বলে না। খেয়ে নেয় চুপচাপ।
একটু পর হঠাৎ বলে, খুব প্রেশার লাগছে জানো!
একটু পর হঠাৎ বলে, খুব প্রেশার লাগছে জানো!
মেয়েটা হেসে বলে, ও। আচ্ছা। এই চিন্তা? I will help you, love.
ওরা বিছানায় শোয়। পাশাপাশি কিছুক্ষণ দেখে একে অপরকে। মেয়েটা মুখ একটু বাড়ালে ছেলেটা এগিয়ে এসে গভীরভাবে চুমু খায়। চুমু খেতে খেতে মেয়েটার শরীরের ওপর উঠে পড়ে সে।
এরপর হাত বাঁধে মেয়েটার। খাটের তলা থেকে একটা ছুরি বের করে।
রেডি?
মেয়েটার চোখ চকচক করে। হেসে বলে, হ্যাঁ!
রেডি?
মেয়েটার চোখ চকচক করে। হেসে বলে, হ্যাঁ!
ছেলেটা লম্বা ছুরিটা দিয়ে জবাই করে তাকে। মেয়েটা কাঁপতে থাকে থরথর করে। ঘগ ঘগ শব্দ হয় কাটা গলা থেকে। উষ্ণ রক্তের পিচকিরিতে লাল হয়ে যায় বালিশ। ছেলেটা চেপে ধরে রাখে।
তারপর মেয়েটা রক্তশুন্য হয়ে গেলে সে কেটেকেটে বের করে মেয়েটার নাড়িভুঁড়ি। তারপর শুকায় ওকে। শরীরের ভিতরে লবণ আর খড় ভরে সেলাই করে সুন্দর করে। চোখ উপড়ে ফেলে পরিয়ে দেয় কাঁচের চোখ। তারপর মোম বসায়। স্টাফ বানায় মেয়েটাকে।
স্টাফ হয়ে গেলে ছেলেটা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে।গলার সেলাইটা সুন্দর হয়েছে। চোখেই পড়ছে না একদম। ও হাসছিলো, জবাইয়ের সময়ে হাসি অনেক কষ্টকর হবার কথা। অধিকাংশরাই পারে না। অন্যদের স্টাফগুলো এত সুন্দর হয় না তাই। কিন্তু ওদের হয়েছে! গর্ব হয় ছেলেটার। কী যে সুন্দর লাগছে ওকে। যেন একটা সুন্দর ভাস্কর্য!
স্টাফ বানানোর পর মেয়েটাকে ড্রয়িংরুমে নতুন শোকেজটায় সাজিয়ে রাখে ছেলেটা।
হ্যাঁ, এইবার সে পাবে হাততালি!
তাসনিম রিফাতের বিশ্লেষণ
ছোট ফিকশন লেখাটা বেশ ঝামেলার। কারণ একটা কাহিনীরে অল্প কয়েক শব্দে প্রকাশ করাটা বেশ কঠিন কাজ। এইখানে আরেক বিপদ হিসেবে হাজির হয় 'টুইস্ট'। টুইস্টে আটকায়ে গেলে,বা পুরা গল্পের ভার ওই টুইস্টের দিকে ঝুলে গেলে গল্পের অপরাপর অর্থ বা থিম হারায়া যাইতে পারে৷ এই গল্পটা এদিক দিয়ে পুরা ঝামেলাটাকে অতিক্রম করছে। টুইস্টে আটকায়ে যায় নাই। টুইস্ট আছে গল্পের স্ট্রাকচারের একটা অংশ হিসেবে। কিন্তু এর বাইরে খুব জোরেশোরে আছে থিম,ইন্টারপ্রিটেশনের জায়গা।
'অন্যদের স্টাফগুলা এত সুন্দর হয় না তাই। কিন্তু ওদের হয়েছে!'
এই 'ওদের' বা আগের কিছু অংশে বুঝা যায় এই স্টাফ করার কাহিনী ছেলেটার দিক থেকে একতরফা না। এতে দুইজনের সম্মতিই আছে। কেন সম্মতি আছে? তাহলে এই গল্প কি আরেকটা দিকেও আমাদের ইঙ্গিত দিতেছে? পাঠক খেয়াল করবেন, এরা নব-দম্পত্তি। মাত্র তাদের সংসার শুরু হয়েছে। সংসার শুরু হইলে, কী হয়? জ্ঞানী-গুণীরা কেউ কেউ সংসারকে বদ্ধ জিনিস হিসেবে দেখে । কিন্তু, কার জন্য বেশি বদ্ধ? নারীর জন্য?
এই গল্পে ছেলেটা মেয়েটাকে স্টাফ করে৷ এরপর সাজায়া রাখে শোকেজে। খেয়াল করেন, যেকোন নতুন সংসারে নতুন ফার্নিচার একটা নতুন স্বপ্নেরও ধারক। সেইক্ষেত্রে শোকেজও। শোকেজে শোপিস সাজায়া রাখা যায়। গল্পের শেষে আমরা দেখি মেয়েটার জায়গা হয় শোকেজে। পাঠক খেয়াল করেন, সানন্দে শোকেজে জায়গা নেওয়া। এইটা কি একটা সংসার জীবনের রূপক আকারে আমরা দেখতে পারি? সংসারের স্বপ্ন কি শেষে বন্দীত্ব দশার দিকে যায়?
এইবার ভাবেন, মেয়েটাকে ছেলেটা সাজায়া রাখে শোকেজে। ছেলেটা এরজন্য হাততালি পায়। হাততালিটা কে দেয়? একটা সিস্টেম। মেয়েটাও খুশি শোকেজে শোপিস হিসেবে জায়গা পেয়ে। কারণ সেও সিস্টেমের মধ্যে বাঁধা পড়ে গেছে। ছোটমামীও এই কাহিনীতে ইনক্লুডেড। তারমানে আরো আরো মেয়ে। আরো আরো ছেলে। এইবার বুঝা যায়, এই গল্প কিভাবে আমাদের সংসার জীবনের খুবই কমন একটা ঘটনাকে (মেয়েদের সংসারে বন্দী হয়া যাওয়া), কেমনে তুইল্যা আনছে!
এইবার স্টাফ হওয়ার বিষয়টা আরো হৃদয়বিদারক লাগবে। কারণ হাসিখুশি শোপিস হওয়ার আগে তো বলী হইতে হইছে তাকে (বা তাদের), নিষ্প্রাণ হইতে হইছে। আর, বন্দীত্ব দশার চেয়ে নিষ্প্রাণতা আর কোথায় আছে?
Post a Comment