কোয়ারেন্টাইন কারাগার | ইফতেখার নিলয়

দ্বিতীয়  কিস্তির পর - 



"আপনারা ঘরে নামায পড়ুন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন, রমযানের পবিত্রতা রক্ষা করুন, একে অপরের জন্য দোয়া করুন।" মসজিদের মাইকে নিয়মিত এই ঘোষণা পাওয়া যাচ্ছে। বন্দিশালা থেকেও আমরা সবাই শুনতে পাচ্ছি। রমযান শুরু হয়ে গেছে, তাই বাড়তি সতর্কতার জন্যেই এই ঘোষণা। আগে আযান দিলেই এলাকার মুরুব্বী, বাচ্চা, তরুণ, যুবক দের ছোটাছুটি শুরু হয়ে যেতে। এখন আযানের পর কাউকে রাস্তা দিয়ে মসজিদের পথ ধরতে দেখা যায়না। আমার সেল থেকে অবশ্য রাস্তা দেখা যায়না তবে ধারণা করা যায়। আমার পাশের সেলের মুরব্বী বন্দি মসজিদে যাওয়া থেকে আটকা পড়েছেন। আমিও উনাদের মত কামরার মধ্যে নামায পড়ি, সেহেরি করি, ইফতার করে রোযা সম্পন্ন করে। বিশ্বাস থেকে হাত তুলে মোনাজাত করে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি চাই। 

মুক্তি পেলে কি করতাম ? মাসের পর মাস যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। মুক্তি পেলে নিশ্চয়ই ছুটে বেড়াতাম। একটা সিগারেট তিনজন ভাগ করে টানতাম, এক কাপ চায়ে আসর জমাতাম, দেশ-বিদেশের নানাম টপিকে আড্ডা জমাতাম, জলসার আয়োজন করতাম টঙ দোকানে। এগুলো সব মূলত আমার পুরাতন অভ্যাস। মুক্ত হয়ে ফিরলে তাই এসব করার-ই স্বপ্ন দেখি পুনরায়। টঙ দোকানের এক কোনায় পড়ে থাকা বেঞ্চ গুলো তো নিশ্চিত আমাদের শূণ্যতা অনুভব করছে। জড় পদার্থের অনেক কষ্ট, আমাদের অনুভূতি শক্তি থেকেও আসলে নাই - 'বুঝে উঠতে পারিনা জড় বস্তুর অনুভূতি।'

যেদিন মুক্ত হবো সেদিন সবার আগে আমি রাস্তায় নামবো। অপরিষ্কার নগরীর পরিষ্কার রূপ সবার আগে দেখার সুযোগ টা আমি হারাতে চাইনা। একটা সুঁই ফেলে দিলেও সেদিন সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে শহরের রাস্তায়। এখনও ফেলে দিলে খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন তো মুক্তির উপায় নেই! আম্মু প্রতিদিন কুরআন পড়ে। এমনটা আগেও হতো। তবে এখনকার পড়ার আওয়াজে দরদের সুরটা একটু বেশী। এটা সম্ভবত ভয় থেকেই আসে। আমার বাড়ির উঠোন আগে এরকম পরিষ্কার থাকতো যেদিন আপু কে দেখতে কোনো নতুন ছেলের পরিবার আসতো। বেশ একটা সাজ সাজ রব থাকতো সেদিন। 

সুনশান নীরবতা আমার পছন্দ না আবার অতিমাত্রায় শব্দও আমার সহ্য হয়না। এখনকার সময়টাকে সুনশান নীরবতার চেয়েও নীরব বলা চলে। Pin Drop Silence In The Crowd - ক্রিকেটের কমেন্ট্রি তে এমন একটা কথা আছে। এখন সেটাই টের হচ্ছে প্রতিনিয়ত। 

আমরা অপরাধ করিনি, শুধুমাত্র পৃথিবীর অসুস্থতাই আমাদের আটকে রেখেছে। আচ্ছা পৃথিবীর এই অসুস্থতায় কি আসলেই আমাদের দায়ভার আছে ? হয়তো আছে। নিজেদের দোষ সবাই আড়াল করতে চায়। এই প্রশ্ন করে আমিও আড়াল করতে চাচ্ছিলাম আমার দোষ। দোষ প্রমাণিত হওয়ার পূর্বেই আমি সাজা ভোগ করছি। কয়েদির পোশাকে কারাগারে বন্দি আছি। এটা আমার দুঃখের কারণ। আমার অসমাপ্ত কাজগুলো কে সমাপ্ত করে দিবে ? 

প্রার্থনা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে মানুষের। মানুষের প্রাপ্তির শেষ নেই! প্রাপ্তির মাঝেও আক্ষেপ আছে সীমাহীন। মুক্তি না পাওয়ার আক্ষেপ। মুক্তি পাওয়ার আক্ষেপও প্রার্থনার মত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে সর্বদা। মুক্তি না পাওয়া সময়টা সবাই কে মানসিক অবসাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই নির্দিষ্ট সময়টার কারণে একটা সময় হয়তো দেশে মানসিক রোগী বেড়ে যাবে। ঘুরেফিরে রাশিয়ার পেটাক কারাগারের বন্দিজীবনের মতোই অবস্থা সৃষ্টি হবে মুক্ত পৃথিবীতে। যেখানে স্বাভাবিক রোগের ডাক্তারের চেয়েও মানসিক রোগের ডাক্তারের সংখ্যা বেশী থাকবে। 

হুট করেই কিছু পরিবর্তন এসেছে নিয়মে। পরিবর্তন গুলো কিভাবে এলো! আর কেন এলো ভাবতে-ভাবতেই আমি অন্যমনস্ক হয়ে ছিলাম কয়েকদিন। আমার আর এই কাগজে নজর দেওয়া হয়নি। দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদিও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটেনি। তার আগেই উন্মুক্ত জায়গা খুলে দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত আমি যে ভাবছিলাম অবসাদগ্রস্ত সমাজ তৈরি হবে তা থেকে পরিত্রাণের জন্য। মার্কেটে যেতে পারবে মানুষ সময় কাটাতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। কিন্তু এটা অবসাদগ্রস্ত জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় ভাবা হলেও, জীবন কেড়ে নেওয়ার আলামত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী।


চলবে......


No comments