কোয়ারেন্টাইন কারাগার | ইফতেখার নিলয়



একটা বিনাশ্রম কারাদণ্ডের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের রজনীগন্ধা ওয়ার্ডের কনডেম সেলের কামরার মত সংকীর্ণ না হলেও, অনুভূতি অনেকখানি সেরকম-ই বলা চলে। আমার পাশের সেলগুলো আমার কামরার মতোই প্রশস্ত। প্রতিটা সেলের বাসিন্দা যে যাকে নিয়ে ব্যস্ত। সবাই নতুন করে দুঃখ বুনছে। মুক্তির আশায় বিভোর আছে। বিচারক হতে কবে জামিন মিলবে ভাবতে ভাবতে মাসখানেক সাজার মেয়াদ পেরিয়েছে। অথচ কেউই অবগত নয়! কোন বিচারক এই বিচারকাজ পরিচালনা করছে। ধারণা করা গেলে অন্তত প্রশ্ন করে জানার উপায় ছিলো সাজার মেয়াদ কতদিন চলবে।

পৃথিবীর সকল কারাগারেই মানসিক শান্তির বড্ড অভাব! এখানেও তাই। কনডেম সেলের ক্ষুদ্র বাতায়নে আলো-বাতাসের যাত্রা একেবারেই নেই বললেই চলে। আমি যেই কারাগারে অবরুদ্ধ সেখানে বেশ বড় জানালা থাকলেও আলো-বাতাস ঢুকতে পারছেনা। এখানে নিয়ম-কানুন রাশিয়ার পেটাক আইল্যান্ড কারাগারের মত কঠোর না হলেও যন্ত্রণা আছে দুঃসহ। এখানে অবশ্য বাইরের দুনিয়ায় ঘটে যাওয়া সকল খবরাদি অনায়াসেই পাওয়া যায়। পত্র-পত্রিকা যদিও নাগালে আসা বন্ধ রয়েছে। আমার জানামতে পুরো পৃথিবী এখন কারাগারে পরিণত। হকারও বোধহয় কোনো এক কারাগারে  বসে আমাকে মনে করছে।

ক্লান্ত হয়ে যখন আকাশের পানে তাকাই জানালার গ্রীল ভেদ করে, তখন যা দেখতে পাই সেটা চোখ মেনে নিতে পারে না, 'আকাশ কেমন যেন ঘোলাটে রূপ ধারণ করেছে।' এখন আর কেউ আকাশের যত্ম নেয় না। আকাশের বুকে ঘুড়ি উড়িয়ে আকাশের সুখ-দুঃখের খবর রাখেনা। আমার কানে আসে পাশের কামরার আরেক বন্দির পায়চারির শব্দ। এখানে টেকনোলজি সহজলভ্য। যদিও এভাবে আর কত! উত্তরটা খুঁজে পাওয়া যায়না। এভাবে কত উত্তর-ই তো আমরা প্রতিদিন খুঁজে যাই। কটার উত্তর-ই বা পাওয়া যায় ? 

অন্যান্য স্বাভাবিক দিনের মতোই এখানে সকালবেলা রুটি-আলুভাজি কিংবা ডিমের অমলেটের নাস্তা তৈরি হয়। নেই কোনো প্রিজোনার'স ক্যান্টিন, তবে খাবারের প্রাপ্যতা আছে, ফুরিয়ে যাওয়ার আতঙ্কের মাঝে। এক কামরার মাঝে কোমরে হাত রেখে পায়চারি করে সময় পার করতে গিয়ে খাবারের রুচি টা গেছে একেবারে বিলীন হয়েছে। বেঁচে থাকাও যে একটা পরীক্ষা সেটা হারে হারে উপলব্ধি হচ্ছে। সারাদিনে যা একটু বাইরের খবর কানে আসে, তা ওই শুধুমাত্র ক'জন বেঁচে আছে, আর ক'জন নতুন করে মৃত্যুর পথ ধরতে যাচ্ছে আগামী ২৪ ঘন্টায় এতটুকুই।

আমার জানালার বাইরে নজর দিলে কারাগারের আরো ১৬ বিল্ডিংয়ের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। হাতেগোনা ২/৪ টা বিল্ডিংয়ের জানালা দিয়ে কয়েকজন বন্দির চেহারার দেখা মিলে। তাদের চোখেমুখে স্পষ্ট হতাশা দেখতে পাই। মাঝে মাঝে গ্রীলের ফাঁক দিয়ে হাত বের করে পৃথিবী কে কাছে টানার চেষ্টা করে। কিন্তু, পৃথিবী প্রতিনিয়ত দূরে ঠেলছে তাদের। সব ঘরে বাতি জ্বলেনা সন্ধ্যা নামলে, ভয় হয় একসময় বাতি ফুরিয়ে যাওয়ার। এই কারাগারে কোনো জেলার নেই তাও কেউ নিয়ম ভাঙছে না। অথচ কত নিয়ম অর্ধেক জীবনে ভেঙেছে,তা না ভাঙলে এই কারাগার জন্ম নিতো না।

পাশের সেলের বন্দির পায়চারি তে আমার ভ্রূক্ষেপ থাকেনা, তারও কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই আমায় ঘিরে। সময় পেরিয়ে যায়, দিন ফুরিয়ে আসে কিন্তু সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার কোনো খবর আমাদের কানে পৌঁছায় না। এটা কি আমৃত্যু সাজা ? এ পথেই দেখতে যাচ্ছি পৃথিবীর শেষ দিন ? আচ্ছা পৃথিবীর শেষ দিনটা দেখতে কি অনেক সুন্দর হবে ? জাগতিক শেষ আনুষ্ঠানিকতা তো একটু ভিন্ন হয়। এ ভাবতে ভাবতেই আমার পায়চারি শুরু হয়ে যায়। গভীর রাত কেটে ভোর নামে পৃথিবীর নব্য কারাগারে। আমি একা একা ভোর দেখি আর বাকিরা ঘুমিয়ে থাকে। অথচ এই ভোর আর স্বাভাবিক পৃথিবীর ভোরের মাঝে বিস্তর তফাৎ রয়েছে। এখনকার ভোরের আলোতে সজীবতা নেই। আছে শুধু হাহাকার আর আর্তনাদের গন্ধ।


No comments