খান সাহেবের টি-ষ্টল | সৈয়দ ইবনুজ্জামান

এই চায়ের দোকানটাকে শুধু চায়ের দোকান বললে একটু ভুল হবে এটা একটা মিনি পার্লামেন্ট। দোকানটা অবৈধ জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে। তাতে কি? এখানে যে মিনি পার্লামেন্ট বসে সেটারতো কোন বৈধতার লাইসেন্স দরকার পড়েনা। দোকানে জোড়াতালির বেঞ্চে বসে চলে দুপক্ষের যুক্তিতর্ক। বেশিরভাগ রাজনৈতিক আলোচনা এখানে বেশি হয়। কাদেরখান এই যুক্তিতর্কে তেমন একটা কান দেন না। তবে এতে তিনি খুশি কারণ যতক্ষন যুক্তিতর্ক চলবে ততক্ষন তার চা-ও বিক্রি হবে। এখানে বেশিরভাগ অবসরে যাওয়া সরকারী কর্মচারীরাই পার্লামেন্ট পরিচালনা করেন। আবার যুক্তি ফুরোলেও কেউ কারো কাছে হার মানে না।

এখানে কোন ফাইল নেই যে, যুক্তিতে হেরে গেলে ফাইল ছুড়ে মারবে। তবে যুক্তিতে হারলে বেঞ্চে জোরে জোরে থাপ্পর দিয়ে সে নামী কোন পত্রিকার মিথ্যে খবর ছুঁড়ে দেয় যার দিন তারিখ তারও জানা থাকেনা। এটা যে শুধু পার্লামেন্ট তাই নয় এটা সুখ-দু:খের ছোট নিবাস। যেখানে যুক্তির পর দুই দল এক পরিবার হয়ে তাদের সুখ-দু:খের কথা বলে। এই যেমন আক্তার সাহেবের ছোট ছেলে মেডিকেলে চান্স পেয়েছে তাই তার খুশিটা আজ একটু বেশি। মোমেন সাহেব তার মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজছেন। এ প্রজন্মের ছেলেদের নিয়ে তাদের অনেক ক্ষোভ। তাদের সামনে উঠতি ছেলেরা সিগারেট কেনে আবার তাদের সামনে আগুনও জ্বালায় । তাদের সময়তো এটা কল্পনাই করা যেত না! কাদের খানকে সবাই খান সাহেব বলেই ডাকে। 

খান সাহেব মাঝে মধ্যে তাদের রাজনৈতিক আলাপে দু একটা কথা বলে ফেলে কিন্তু আজ সে বলছেনা। বাসায় বউকে পিটিয়ে এসেছে তাই বউ এর জন্য মনটা খুব খারাপ লাগছে। নাক দিয়ে রক্তও বেরিয়েছিল। সংসারে শুধু অশান্তি! চায়ের দোকান দিয়ে কি সংসার চলে! খান সাহেবের বয়স ৪৯-৫০ হবে। ঘরে দু’মেয়ে এক ছেলে। অনেকেই বলেছিল মেয়ে দুটোকে গার্মেন্টসে কাজে লাগিয়ে দিতে। মেয়ের টাকা বাপ খাবে! এর কাছে বড় অপমান তার কাছে আর কিছুই নেই। দুপুর হয়েছে ভাত খেতে যেতে হবে কিন্তু চা’র দোকানে কেউই নেই যাকে রেখে যাবে। ছেলেটা দোকানে বসে না। ছেলের শুধু ইচ্ছা সে সিনেমার হিরো হবে। ছেলেকে দোকানে বসিয়ে গেলে সে ক্যাশ থেকে টাকা চুরি করে। সিনেমার হিরো হতে পারলে প্রথমে সেই খুশি হত।



কিন্তু সে জানে ধনীরা আরো ধনী হবে আর গরীবরা আরো গরীব হবে। এটা সে শুনেছিল। কার থেকে শুনেছিল তার মনে নেই। তাই ছেলের ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দেয়না সে। ছেলের সরকারী চাকরীর জন্য গ্রামের বাড়ির বসতভিটা বেঁচে এক দালালকে ২ লক্ষ টাকা দিয়েছে। সরকারী চাকুরী আজকাল সোনার হরিণ। আর হরিণ কিনতে গেলে তো অনেক টাকা লাগে আর যদি হয় সেটা সোনার! ছেলেটা মেট্রিক পর্যন্ত পড়েছে এরপর আর পড়েনি। ছেলেটার চাকরীটা হয়ে গেলে মেয়ে দুটোর বিয়ে দেবে এরপর আর চা’র দোকানদারি করবেনা। আজকে ছেলের চাকরীর রেজাল্ট দেয়ার তারিখ কিন্তু সে দালাল ফোন করছেনা। 

সে মাত্র দোকান বন্ধ করল ওমনি দালালের ফোন এল। কিন্তু কিছু বলার আগেই সংযোগটি কেটে গেল। ছেলের চাকুরীটা বুঝি হয়ে গেল! খান সাহেব দ্রুত যেখানে নোটিশ বোর্ডে রেজাল্ট দেয়া হয়েছে সেখানে পৌঁছে গেলেন। ভিড় ঠেলে সে সামনে গিয়ে রেজাল্ট দেখল। কিন্তু না, ছেলের নাম নেই। খুব বেশি হতাশ হয়ে অনেকক্ষণ পায়ে হেটেই তার চা’র দোকানে পৌঁছালো। তখন সন্ধ্যা ৬টা। চা’র দোকানটা ভ্রাম্যমান আদালত ভেঙ্গে দিয়েছে এবং নোটিশ লাগিয়ে দিয়েছে। খান সাহেবের এখন চিৎকার করে কাঁদার কথা। কিন্তু সে ভাঙ্গা দোকান থেকে একটা সাইনবোর্ড নিল যাতে লেখা, খান সাহেবের টি-ষ্টল। সাইনবোর্ডটা নিয়ে খান সাহেব যাত্রা শুরু করল হয়ত তার পুরোনো ঠিকানায়। যেখানে অভাব অনটন আর কিছু আশার রংবাজি ।

No comments