মৃত্যুর উৎসব | মোহাম্মদ সাফি
ঐ যে সিলিং ফ্যানটা দেখছেন না? ঐ
ফ্যানটার মাঝে অামার লাশটা ঝুলে
অাছে। জিহবাটা অস্বাভািবকভাবে
বের হয়ে অাছে। গলাটা ফুলে লাল
হয়ে গেছে মোটা খসখসে দড়ির জন্য।
পরনে নতুন জামা, খুব দামি ব্র্যান্ডের
কাপড়।
বিশাল এক বেডরুম। বেডরুমটার এক পাশে
একটা ড্রিম লাইট মৃদু অালো ছড়াচ্ছে।
ফ্লোরের ঠিক মাঝ বরাবর একটা জলন্ত
মোমবাতি পুড়ছে। এক পাশে কাগজে
কিছু কালো মত জিনিস মানে গাজা
পড়ে অাছে, সাথে অাছে দামি
ব্র্যান্ডের ৩ টা ডবল সিগারেটের
প্যাকেট। এ্যাশ ট্রে তে ছাই উপচে
পড়ছে। তার পােশ পড়ে অাছে একটা
কোকের বোতল অার একটা খাবারের
বক্স।
জানালাটা পশ্চিম দিকে।
জানালাটা সম্পূর্ণ খোলা। জোছনার
অালো রুমে ঢুকে পড়ছে। ড্রিম লাইটের
মৃদু অালো, মোমবাতির অাগুন রঙের
অালো অার জোছনার ফর্সা অালো
মিলে একটা কেমন দম বন্ধ করা পরিবেশ
সৃষ্টি করেছে। রুমটার মাঝে এক
প্রকারের পোড়া অাতরের গন্ধ, খুব বিকট
এক গন্ধ।
যে বাড়িটার কথা বলছি, সেটা একটা
ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়ির বাইরের
তালা বন্ধ অবস্থায় ঝুলছে। গেটের একদম
অপর প্রান্তের দ্বিতীয় তলায় ঐ
বেডরুমটা, যেখানে অামার লাশটা
অাছে। বাড়িটা খুব সাজানো-
গোছানো। কোনো খুঁত নেই। একপাশে
একটা বাগান অাছে। বাগানের সব
গোলাপ প্রস্ফুটিত।
বাড়ির ড্রয়িং রুমে দেয়ালের একটা
অংশ জুড়ে খুব বড় একটা ফ্রেমে
বাঁধানো স্কেচ করা একটা ছবি।
ছবিটাতে ঐ যে মহিলাটা, উনি
অামার মা। অার ওনার কোলের ছোট্ট
মেয়েটা অামার বোন, নিশাত।
বত্রিশটা দাত বের করে যে ছোট
ছেলেটি হাসছে সেটা অামি, অার
অামাকে জড়িয়ে ধরে অাছেন
অামার বাবা, জাবেদ শেখ।
"জাবেদ শেখ", নামটা রাজকীয় না?
হ্যা, ঠিক এরকম একটা রাজকীয় মনের
অধিকারী ছিলেন অামার বাবা।
বিয়ের পর খুব সুখে-শান্তিতেই দিন
কাটাচ্ছিলেন। দু'বছর পর অামার জন্ম হয়।
প্রথম সন্তান, তার উপরে ছেলে।
অামাকে পেয়ে বাবা অার মা যেন
সাত রাজ্যের ধন একসাথে পেয়েছে
মত করেছিলো। বাবা অামাকে
নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন সব সময়। অানন্দে
মাতোয়ারা এক দম্পতির বুকে অামি
শুভ্র, অার তার পরের বছর সংসার
অালোকিত করতে সৃষ্টিকর্তা
পাঠালেন ফুটফুটে একটা মেয়ে,
নিশাত নাম। নামটা যখন নিশাত রাখা
হয়েছিলো, সবাই বলছিলো - "হ্যা, এই
মেয়েটার নাম নিশাত হওয়া উচিত।
নামের সাথে বাচ্চাটার দারুণ মিল
অাছে।"
বাবা-মায়ের ঘর তখন পুরো
অালোকিত। এক শুভ্র অার এক নিশাত,
মানিক জোড়া অামরা। সাধারণত দু-এক
বছরের পার্থক্য হওয়া ভাই-বোনের
জুটিগুলোতে সারাক্ষণ ঝগড়া লেগেই
থাকে। কিন্তু অামরা ব্যতিক্রম ছিলাম।
অামি নিশাতকে ছাড়া কিছু বুঝতাম
না, নিশাত অামাকে ছাড়া কিছু
বুঝতো না।
এখন যেখানে অামার লাশ ঝুলছে,
সেখানে অাসলে অামাদের বেডরুম
ছিলো। অািম অার নিশাত একসাথে
ঘুমাতাম। নিশাত অামাকে জড়িয়ে
ধরে ঘুম যেতো। একরাতে ও এক ভয়ঙ্কর
স্বপ্ন দেখে, ঘুম থেকে উঠেই অামাকে
জাগিয়ে দিয়ে অামাকে ধরে ভয়ে
কান্না শুরু করে দেয়। অামি এখন মৃত,
অামার এখনো মনে অাছে। অািম
অার নিশাত ভাত খেতে চাইতাম না,
মা অামাদের দুজনকে রূপকথার গল্প
বলতেন। অামরা মন্ত্রমুগ্ধের মত সব গল্প
অার খাবার একসাথে গোগ্রাসে
গেলতাম। এইভাবেই অামরা বেড়ে
উঠতে থাকি।
অামার মা ছিলেন একজন দক্ষ মা,
শিক্ষাজীবনে তিনি সাইকোলোজি
নিয়ে পড়েছিলেন। অার বাবা ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা
করেন। অাগেই বলেছি, রাজকীয় এক
মনের অধিকারি ছিলেন। তার
সহধর্মিণীও ছিলেন তার মত।
ছোটবেলা থেকে কখনো প্রহার করে
নাই অামাদের, ভুল করলে বুঝিয়ে
বলতেন। অামরা ছিলাম সুবোধ সন্তান।
এই যে দেখেন, এই বাগানটা। অামার
মা করেছেন বাগানটা। অামরা এই
চত্বরে খেলা করতাম, অামাদের শব্দে
বাগানের প্রতিটি পাতা হাসতো।
এভাবেই অামাদের জীবনের চাকা
কিছু পথ এগুলো।
অনেকেই বলে থাকেন, কিছু ফুলের জন্মই
হয় অকালে ঝড়ে যাওয়ার জন্য।
হ্যা, ব্লাড ক্যানসার হলো নিশাতের।
নিশাতকে বাঁচাতে অামার বাবা
কিভাবে পাগলের মত ছুটছিলো এক
হাসপাতাল থেকে অারেক
হাসপাতালে তা অামার এখনো মনে
অাছে। অামি অনেক কিছুই বুঝি নি
তখন। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতাম, মা
নিশাতের জন্য পাগলপ্রায় হয়ে
বিছানায় শুয়ে চোখের পানি
ফেলতেন, অনেক সময় জ্ঞান হারাতেন।
অামি মায়ের রান্না ছাড়া কিছু
খেতে পারতাম না। তখন বাধ্য হয়ে
খেতাম।
বাবা যেদিনটির অাশঙ্কা করতো
প্রতিটা সময়ে, ঐ দিনটি চলে অাসলো।
নিশাতের দেহটাকে সবাই লাশ বলা
শুরু করলো, নিশাতের অাত্মা
অাজরাঈল (অাঃ) কবজ করে ফেললো।
অধিক শোকে পাথর হয়ে গেলেন
বাবা, মা মূর্ছা যেতে লাগলেন
বারবার, জ্ঞান ফেরার পর নিশাত
নিশাত বলে বিড়বিড় করে কি কতগুলো
বলে অাবার জ্ঞান হারাতেন।
মাটির নিচে চলে গেলো লাশটা।
মা মানষিকভাবে প্রচন্ড ভেঙ্গে
পড়তে থাকলেন। শরীরও খারাপ হতে শুরু
করলো। ডায়েবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের
সমস্যা দেখা দিচ্ছে এরকম অবস্থা!
মানষিক শক্তিই বেচে থাকতে
সাহায্য করে অামাদেরকে, কিন্তু সেই
মানষিক শক্তি লোপের সাথে যদি
শরীরও ভেঙ্গে পড়ে মৃত্যুই কাম্য।
বোনটাও গেলো, তার সাথে মাও।
অামার এখনো মনে অাছে স্পষ্ট, ঐ
বর্ষার রাতে মায়ের খুব জ্বর! বাবা
ডাক্তার নিয়ে অাসলেন। ডাক্তার
কিছু ঔষুধ লেখে দিয়ে চলে গেলো।
অাস্তে অাস্তে বাড়তে থাকলো জ্বর,
পুড়ছিলো শরীর।
মাথায় পানি দিতে থাকলাম কিন্তু
মৃত্যু যার জীবনে কড়া নাড়ে, তাকে
বাঁচানোর চেষ্টা বোকামি।
ফযরের অাজানের ঠিক অাগে মা-ও
লাশ হয়ে গেলো।
অামি শুভ্র অামার জীবনের শ্রেষ্ট
সম্পদ অার বাবা তার ভালোবাসার
মানুষকে হারিয়ে উভয়েই কংক্রিটের
স্তম্ভ হয়ে গেলাম।
বাবা খুব ভালোবাসতো মাকে। ঐ
ভালোবাসাই পূিজ করলেন বাবা।
দ্বিতীয় একটা বিয়েও করেন নি।
কোলেপিঠে করে মানুষ করতে
লাগলেন অামাকে। অামি মায়ের
অভাব অার বোধ করি নি। বাবা
অামার অাদর-সোহাগের রাজ্যের
রাজা আর অামি রাজপুত্র।
মনে মনে ঠিক করলেন তিনি, অামাকে
মানুষের মত মানুষ করবেন। উচ্চ-শিক্ষিত
এক নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান ব্যক্তি
বানাবেন অামাকে। স্বপ্ন পূরণের সকল
চেষ্টা শুরু করে দিলেন। এই বাবাকে
সম্বল করে বড় হতে লাগলাম।
পড়ালেখাতে মনোযোগ ভালোই
ছিলো অামার। শহরের নামকরা
সরকারি স্কুলে চান্স পেলাম। প্রতি
ক্লাসের রেজাল্ট প্রসংশনীয়।
এভাবেই দেখতে দেখতে এসএসসি
দিয়ে দিলাম। রেজাল্ট গোল্ডেন
জিপিএ-৫ অাসলো। রেজাল্ট শুনে
বাবা অানন্দে চোখের পানি বিসর্জন
দিয়ে দেন।
কলেজ জীবনে পা দেই। তাও অাবার
সরকারী কলেজে ভর্তি হলাম।
অনেক ফ্রেন্ড হতে থাকলো, মেয়ে-
ছেলে মিলে অনেক ফ্রেন্ড। অাস্তে
অাস্তে ফ্রেন্ডদের সাথে টাইম
কাটানো বাড়তে থাকলো।
হঠাৎ বুকের মাঝে প্রেমের দামামা
বেজে উঠলো। সবকিছুই অজান্তে হয়ে
গেলো, তার প্রতি অাকর্ষণ, প্রেম-
ভালোবাসা; সব!
"উপমা" মেয়েটার নাম।
একসাথেই পড়তো অামাদের সাথে।
অাস্তে অাস্তে তার সাথে ক্লোজ
হওয়ার অাপ্রাণ চেষ্টা করতেই না
করতেই তার ক্লোজ ফ্রেন্ডদের মধ্যে
অামি অন্যতম হয়ে গেলাম। তার
ছেলেবন্ধু অনেক। এই জিনিসটা খারাপ
লাগতো তবুও প্রেমে তো পড়ে
গিয়েছি তার, কি অার করার অাছে
অামার? হয়তো ভালোবাসা বদলে
দেবে তাকে! সেই দিনের প্রহর গুণছি।
হ্যা, দীর্ঘ ২৪৩ টা দিন পরে এক পর্যায়ে
অামি একটা পার্কে তাকে প্রপোজ
করি, সে স্বপ্নের মত অামাকে সাথে
সাথেই এক্সেপ্ট করে ফেলে।
ধীরে ধীরে তার প্রতি অাসক্ত হতে
থাকি, পাগল প্রেমিক হয়ে যাই।
পড়ালেখার অবস্থা ক্রমশ খারাপ
হচ্ছিলো। কিন্তুটা এতটা খারাপ হয়
নাই যে এইচএসসিতে এ+ মিস করবো।
ঠিকই এইচএসসি দিলাম অার এ+ পেলাম।
বাবা সেই দ্বিতীয় বার অামাকে
জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলেন।
বলেছিলেন - "বাবা, তুই অনেক বড় হবি।
অামার সব স্বপ্ন তুই পূরণ করবি। অামার
স্বপ্ন তুই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বি! "
সেই স্বপ্ন পূরণ করতে অামি পড়তে
থাকলাম, যেই করেই হোক অামাকে
বাবার স্বপ্ন পূরণ করতেই হবে।
কিন্তু প্রেমের মজনু যে অামি
ভালো করে পড়ালেখা করতে
পারলাম না চেষ্টা করেও। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলাম না,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়েটিং
লিস্টে ঝুলে থাকলাম। তাই প্রাইভেট
ভার্সিটিতে এ্যাডমিশন নিলাম।
অার ঐদিকে অাস্তে অাস্তে উপমা শুরু
করলো উপমা দিয়ে তার নিকৃষ্ট
মেেয়মানুষের রূপ দেখাতে যাদের মত
মেয়ে ভালোবাসা চায় না, কারণ
তাদের মন যে সব ভালোবাসা টাকার
দুয়ারে রেখে এসেছে।
ধীরে ধীরে শুরু করলো এড়িয়ে চলা।
হঠাৎ এই পরিবর্তনে অামি স্তম্ভের মত
স্তম্ভিত হয়েছিলাম।
অাসলে অামাদের স্বভাব খারাপ,
কাছের মানুষটি যখন অামাদের
ভালোবাসার দাম না দেয়া শুরু করে,
অামরা ততই অাসক্ত হতে থাকি পছন্দের
মানুষের প্রতি, অারো বেশি
ভালোবাসতে থাকি।
অামিও ঠিক সেরকম করতে থাকি।
সেই দিনটি ঘনিয়ে অাসলো যেদিন
উপমা তার পরিবারের ইচ্ছা-
অাকাঙ্খাকে প্রাধান্য দিয়ে ধরলো
এক প্রবাসী ছেলের হাত শুধু মাত্র
টাকার লোভে অার অামার
ক্যারিয়ার অনিশ্চিত এই ধারণা
থেকে।
বিয়ে দিয়ে দিলো উপমার পরিবার
উপমাকে। অার সেই বিয়ের অনুষ্ঠানের
নিমন্ত্রণপত্র পেলাম উপমার বিয়ের
অাগের দিন সকাল বেলা।
কলেজের প্রথম থেকেই সিগারেট
খেতাম। বাবা অনেক কষ্ট
পেয়েছিলো যেদিন জানলো বাবা
যে অামি সিগারেট খাওয়া শুরু
করেছিলাম। বহু চেষ্টার পরেও অামি
বাবার অনুরোধকে উপেক্ষা করে
প্রাধান্য দিলাম সিগােরটকে।
বিয়ে হচ্ছিলো কমিউনিটি
সেন্টারে, অামি গেলাম সেখানে।
গিয়ে দেখে অাসলাম উপমাকে। বাহ!
সুন্দর লাগছে উপমাকে খুব। মনে হচ্ছে
নিজ থেকেই কারোর জন্য সেজে
এসেছে। বর পাশে বসা। বাহবা! ছেলে
তো পুরোই প্রিন্সের মত দেখতে।
ধনসম্পদের গোডাউনের মালিক যে
দেখলেই বোঝা যায়। দুজনকেই সুন্দর
মানিয়েছে পাশাপাশি। উপমার
ঠোটে লাল লিপস্টিক, সেই হাসি
অাজ তার মুখে যেই হাসি দুবছর অাগে
অামার সাথে হাসতো।
অামি ব্যর্থ প্রেমিক। প্রেমিক হয়ে
প্রেমিকার বিয়ে দেখে অাসলাম
চোখে।
এই চোখ সেই রাতে নেশার স্বপ্ন
দেখাতে শুরু করলো, তা সিগারেটের
না, এক নেশা ছিলো উপমা, সে নেই,
নেশার স্থান শূণ্য থাকতে পারে না,
শূণ্য নেশার স্থানে জায়গা করে
নিলো মারিজুয়ানা অর্থাৎ গাজা।
অাগের সেই প্রেম দিয়ে দিলাম
নেশাকে, অাসক্ত হচ্ছিলাম নেশাতে।
গাজা স্মৃতিশক্তি দুর্বল করে দেয়। হ্যা,
পেরেছিলোও বটে অামার মস্তিষ্কের
থেকে উপমার স্মৃতি মুছে দিতে, তার
সাথে মুছে দিলো বাবার স্বপ্ন পূরণের
কথাগুলোও, মুছে দিলো মায়ের
অামাকে প্রতিষ্ঠিত করে তোলার
স্বপ্নের স্মৃতিগুলোও। সব মুছে দিলো।
স্মৃতিরা বেহায়া হয়, পিছু ছাড়ে না,
গাজার কল্যাণে তাদের সব প্রয়াস ব্যর্থ
হলো।
ফুলের মত শুভ্র, হয়ে গেলাম
গান্ঞ্জাখোর। ঘরে বসেই নেশা করতে
শুরু করলাম। অাস্তে অাস্তে তার
প্রভাব পড়তে শুরু করলো।
বাবা সব বুঝতে থাকলেন। একদিন সম্পূর্ণ
নিশ্চিত হয়ে অামার কাছে অাসলেন।
অামি তখন গান্ঞ্জার ধোয়া শরীরে
পালন করছি এই অবস্থায় বাবার অাগমন।
-শুভ্র!
অামি উত্তর দিতে পারলাম না।
-বাবা শুভ্র!
-জ..জ্বী!
-কি করছিলি একটু অাগে?
-হ্যা?
-শুনছিস না অামার কথা! বলছি, কি
করছিলি একটু অাগে।
-কিছুই করছিলাম না।
-তোর চোখ লাল কেন?
-অামি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে
অামার চোখ লাল না।
-তুই কিভাবে দেখবি তোর চোখ লাল
কিনা?
-সেদিনের পর থেকে.....
-কোন দিন?
-জানি না।
-তোর কথা এরকম অসংলগ্ন লাগছে কেন?
তুই তো এরকম ছিলি না।
-তুমি যাও ঘর থেকে। অামার কথা
বলতে ভালো লাগছে না অাব্বু!
বাবা উঠে চলে গেলো। বাবা চলে
যাওয়ার সময় খেয়াল হলো তার চোখে
পানি টলমল করছে।
পরের দিন ঘুম ভাঙ্গলো দুপুরে। বাবা
জিজ্ঞেস ভাত খেতে খেতে
জিজ্ঞেস করলো,
-কেন এই পথে শুভ্র? তোর মা অার
বোনের কথা মনে পড়ে না? তারা
থাকলে কি কষ্ট পেতেন না তোর এই
অবস্থা দেখে?
-অামার কিছু যায় অাসে না।
-যায় অাসে না মানে? তুই এত পাষাণ?
-হ্যা অামি শুভ্র অার অাগের শুভ্র নেই।
অামি পাষাণ হতে বাধ্য হয়েছি, বাধ্য
করেছে সে অামাকে।
-কে সে? যার জন্য তুই তোর জীবনটা
তিলে তিলে নষ্ট করে দিচ্ছিস?
-উপমা। অামি তাকে ভালোবাসতাম।
সে অামার ভালোবাসার গুরুত্ব না
দিয়ে অাজ বিবাহিত।
-একটা মেয়ের জন্য তুই তোর জীবন ধ্বংস
করে দিবি? তোর বিবেকে অাটকায়
না এসব কাজ করতে?
-না অাটকায় না। সে অামার সাথে ২
বছর প্রেম করে ২০০ বছরের স্বপ্ন
দেখিয়েছে। সেই স্বপ্নে অামি
ছিলাম অাসক্ত। নেশা করতাম সেই
স্বপ্নদের নিয়ে। অাজ সেই স্বপ্ন
দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে ফেলে দিতে
হয়েছে। অামি এখন গাজা নিয়ে
নেশা করি। এতে কারোর কিছু যায়ে
অাসলেও অামার কিছু যায় অাসে না।
বাবা অামাকে খুব জোরে এক থাপ্পড়
দিলেন। অামি রাগ করে একটি গ্লাস
ভেঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। খুব
রাগ হলো, যে বাবা এতদিন কোনো
ভুলের জন্য অামার গায়ে হাত তুলেন
নাই, অাজ সেই বাবা এরকম একটা কাজ
করতে পারলো?
চলে গেলাম গান্ঞ্জার অাসরে।
গাজা খেয়ে সেই নেশার স্বপ্নে
মাতাল হয় বাসায় এসেই ঘুমিয়ে
পড়লাম।
স্বপ্ন দেখলাম,
অামার মা অার নিশাত অামার
পাশে বসে কান্না করছে।
বারবার বলছে - " শুভ্র তুই এমন কেনো
হয়ে গেলি?"
অামি চমকে ঘুম থেকে উঠে গেলাম।
দেখি বাবা অামার পাশে বসে বসে
কান্না করছেন। অামাকে জাগ্রত হতে
দেখে তিনি চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর দেখলাম, বাবা বাইরে
গেছেন। হবে হয়তো কোনো কাজে
গেছেন।
অামি ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে বাড়ির কাজের ছেলেটার
ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গলো, তার
চেহারা অাতঙ্কিত।
অামি জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে?
সে কিছু না বলে চলে গেলো। হঠাৎ
খেয়াল হলো অাজ বাড়িটাকে খুব
জীবন্ত মনে হচ্ছে। জীবন্ত কিভাবে
হবে, এই বাড়ি তো মৃত যেদিন অামার
মা অার বোন বাড়ি ছেড়ে অসীমের
উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন। নাকি
মৃত্যুর অারেক উৎসব সংগঠিত হয়ে
গেছে?
অামার ধারণা সঠিক হলো। বাড়ির
ড্রয়িংরুমে অনেক মানুষ অার তাদের
মাঝে একটি খাটিয়া। চারপাশে
অাগরবাতি। কিছু মহিলা কোরান
পড়ছেন। সবাই অামার দিকে এভােব
তাকিয়ে অাছে কেন?
অামি কম্পিত বুকে খাটিয়াতে রাখা
লাশের মাথা থেকে কাপড় উঠালাম।
অামার জীবনের প্রদীপ নিভে গেলো
সেই মুহূর্তেই যখন অামি লাশ হিসেবে
বাবাকে অাবিষ্কার করলাম।
অামি হয়তো জ্ঞান হারিয়েছিলাম।
জ্ঞান ফিরলে জানতে পারি বাবার
লাশ দাফন হয়ে গিয়েছে। কেও
অামাকে শত চেষ্টা করে জাগাতে
পারে নি। এটাও জানতে পারলাম যে
ঐদিন বাসা থেকে কিছু দূরে বাবা
ট্রাক এ্যাকসিডেন্ট মারা গিয়েছেন।
অামি একে একে সব মনে পড়লো।
অামি সেই রাতে প্রায় ২৫ টার মত
সিগারেট খেয়েছিলাম। ঘুমানোর
অাগ পর্যন্ত বারবার মনে হচ্ছিলো
বাবা অামার দেওয়া কষ্ট সহ্য করতে
না পেরেই এই অাত্মহত্যার পথ বেচে
নিয়েছেন। তিনি ট্রাকের নিচে
নিজেকে ইচ্ছা করেই বিসর্জন
দিয়েছিলেন।
অামি এরপরে অারো ১ সপ্তাহ বেচে
ছিলাম। বেচে থাকার প্রতিটা মুহূর্ত
অামার কাছে জাহান্নামে থাকার
মত মনে হচ্ছিলো। হতচ্ছাড়া বিেবক
অামাকে সাপের মত দংশন করছিলো
প্রতিটি মুহূর্তে!
অামি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি
বাবার পদানুসরণ করবো।
ঠিক করলাম সেই রাতটি। টাকা পয়সা
যোগাড় করলাম। তিন প্যাকেট দামী
ব্র্যান্ডের সিগারেট অার এক পোটলা
গাজা কিনে ফেললাম। সাথে
কিনলাম একটি কোক অার এক প্যাকেট
বিরিয়ানি।
রাত অাসলো।
অামি জামা কাপড় পরে মৃত্যুর উৎসবে
যোগ দেয়ার জন্য বাবার দেয়া গত
জন্মদিনের সেই শার্ট-প্যান্ট পড়লাম।
ব্যবস্থা করে বাড়ির বাইরে তালা
দিয়ে দিলাম যাতে সবাই বুঝতে
পারে যে এই বাড়িতে কেউ থাকে
না।
তারপর ঘরের ড্রীম লাইটটি জ্বালিয়ে
দিলাম। পশ্চিমের জানালাটা খুলে
দিলাম। পর্দা উড়ছে বাতাসে। অামি
পছন্দের বিরিয়ানি খেলাম কোকসহ,
জীবনের শেষ খাদ্য তো! তারপর একের
পর এক সিগারেট খেতে থাকলাম।
পুরোনো সব স্মৃতি মাথায় ভর করতে
থাকলো। অামি কিছুই পাত্তা
দিচ্ছিলাম না। সিগারেট শেষ হলে
গাজা খাওয়া শুরু করলাম। দেখলাম,
বাবার একটা ছাযা অামার পাশে
বসে কান্না করছে। তবুও খাওয়া বন্ধ
করলাম না। প্রায় অনেকটুকু খাওয়ার পর
দেখলাম অামার খুব ঘুম অাসছে। সমস্যা
তো নেই, একটু পর চিরনিদ্রার দেশে
চলে যাবো।
ফাঁসির দড়ি অাগের থেকেই রেডি
করে রেখেছিলাম।
চেয়ারের উপর দাড়ালাম। ফ্যানের
সাথে ঝুলানো সেই মোটা রশি গলায়
পড়লাম। দাড়িয়ে থাকলাম। ঘুম
পাচ্ছিলো তখন খুব। হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ
হারিয়ে ফেললাম। চেয়ার পা থেকে
সড়ে গেলো। অামি ঝুলতে লাগলাম
যদিও খুব কষ্ট হচ্ছিলো।
এরকম অবস্থায় সময় বয়ে চললো অার
অামার জীবন শেষ হয়ে গেলো একসময়।
এই যে অামি শুভ্রের অতৃপ্ত অাত্মা।
পরিবারটা খুব সাজানো-গোছানো
ছিলো। সেখানে ঝড় এসে নিয়ে
গেলো একে একে মা-বাবা বোন
সবাইকেই! অামি মৃত্যুর পথে তাদের
মিছিলে শামিল হয়েছিলাম এই
ভেবে যে তাদের দেখা পাবো।
কিন্তু না, তারা সবাই হয়তো
জান্নাতে এখন অার অামি পুড়বো
জাহান্নামে অনন্তকাল। অামি
অাভাস পাচ্ছি।
অাচ্ছা, জীবিত মানুষ অাত্মহত্যা করে
দুনিয়ার সব কিছু থেকে মুক্তি পায়,
অামার মত অাত্মারা কি অাত্মহত্যা
করতে পারে না সব কিছু থেকে মুক্তির
জন্য?
বাড়িটির ঠিক পাশের একটি পার্কে
এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা বসে
অাছে। প্রেমিক বললো,
-সারাজীবন পাশে থাকবে তো?
-অবশ্যই মৃত্যুর অাগ পর্যন্ত তোমাকে
ভালোবেসে যাবো। অামি তোমার
মনকে ভালোবাসি, তোমার টাকাকে
না।
অাশ্চর্যে ব্যাপার হলো সেই প্রেমিক
ছেলেটির নামও শুভ্র!
না জানি তারও ঐ বাড়িতে ঝুলে
থাকা লাশের মত করে পঁচতে হয় নাকি!
Post a Comment