ব্রাত্য রাইসুর নৈরাজ্যের আকার ও অসারতা | আহমাদ মুজাহিদ
ইতিমধ্যে আমি আমার বেশকিছু সমালোচনামূলক গদ্যে শক্তিশালী ভাবেই ব্রাত্য রাইসুর শিল্পচর্চার ফাঁকিবাজি, অযুক্তি, ও অসারতা দেখিয়ে গেছি; এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলা ভাষার সমকালীন শিল্পচর্চায় ব্রাত্য রাইসুর সমালোচনা কেন জরুরী, কিংবা কেন ব্রাত্য রাইসুর শিল্পভাষ্যের অসারতা প্রমাণ আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর এতবিধ প্রশ্নের জবাবগুলো এই আলোচনার সমাপ্তিতেই প্রাপ্ত হওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
যাইহোক, আমার এই গদ্যে জনাব ব্রাত্য রাইসু কতৃক উল্লিখিত উনার সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ কবিতা বা যাকে আমি কবিতা বলতে চাইনা, তার অন্তর্বয়নের বিশ্লেষণ রাখা হবে। সেইসাথে, এই কবিতাটি কেন কবিতা হয়ে উঠেছে এই বিষয়ক ব্রাত্য রাইসুর প্রদানকৃত নান্দনিক বক্তব্যের বিপরীতে সুচিন্তিত যুক্তির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে তার কবিতা না হয়ে উঠতে পারাটা কিংবা কেন একে কবিতা বলে বিবেচনা করবোনা আমরা।
সেইসাথে এটা উল্লেখ করা প্রয়োজনীয় যে, আমার এই আলোচনায় যুক্তি ও জ্ঞানের যুগপৎ সম্মতিতে কবিতার সারমর্ম কিংবা অস্তিত্বধারী সত্তা হিসেবে কবিতার উপযোগীতা কী হতে পারে সেই বিষয়ক সিদ্ধান্ত সহকারেই বিবেচনার চেষ্টা করা হয়েছে। তাই, দৃষ্টির প্রখর ও গুঢ়, অন্তর্ভেদী অংশের সাহায্যে-ই এই গদ্যের সারমর্ম লাভ করার স্বার্থে প্রস্তুত হওয়ার জন্য এর পাঠকদের অনুরোধ করা গেলো।
পছন্দ ও ঘৃণা
“ব্রাত্য রাইসু লিখিত ১৯৯৭ সালের কবিতা ‘দোরা কাউয়া পেয়ারা গাছে’ বাংলার কবিসমাজের রুচি ও কবিতা সম্পর্কিত অবস্থানরে স্পষ্ট দুই ভাগে ভাগ কইরা দেয়।
যারা এই কবিতা পছন্দ করেন।
যারা এই কবিতা ঘৃণা করেন।
এইটা কবিতায় কী আসতে পারে না পারে তা সম্পর্কে কবিদের প্রমিত রুচিশীলতা ও কবিতা-ধারণার দৌড় বুঝতে সাহায্য করে।”
শিল্পের বিবেচনায় পছন্দ ও ঘৃণা নামক মানস অভিব্যক্তির সাহায্য অবশ্যই নেয়া হয়না। তাই কোন ব্যক্তির, যদি কোন শিল্পখণ্ডের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ঘৃণার উদ্রেক হয়, যদি সত্যিকার অর্থেই কোন শিল্পী করতে পেরেছেন বলে দাবী করেন, তাহলে এই প্রকার গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্মের দেখা অবশ্যই আমরা পেতে চাইবো। তবে তার পূর্বে বলতে চাই, আমি প্রণীত কবিতা পাঠে শুধুমাত্র কবির ব্যক্তিগত ঘৃণার প্রকাশই দেখেছি, সেই অনুসারে এখানে শিল্পীর ব্যক্তিগত মানস-অভিব্যক্তির উৎসারন-ই ঘটেছে, আর কোন উল্লিখিত ঘটনা অর্থাৎ ‘পছন্দ’ কিংবা ‘ঘৃণা’ নামক মানসিকতার অবস্থায় উপনীত হওয়া গেলোনা।
আমি এর পাশাপাশি আরো একটু যোগ করতে চাই যে, শিল্পের বিচারে আমরা প্রধানত যে সকল মানস অভিব্যক্তির সাহায্য গ্রহণ করে থাকি এগুলো মূলত দ্বিবিধঃ আনন্দ এবং নৈঃশব্দ। এছাড়া আরো গুরুত্বপূর্ণ নিত্য নতুন মানস ক্রিয়াকেও শিল্পের সামগ্রিক অর্থে যুক্ত করার কাজ বাংলা কবিতায় ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে, তাদের আকার ও অবস্থা নিশ্চই ভবিষ্যতে আমরা পেয়ে থাকবো এই আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়।
স্বর্গ-চিন্তা
“অপছন্দ বা ঘৃণাদল নিয়া আমার যে ভাবনা:
এরা নগ্নতাকে সৌন্দর্য আকারে দেখতে চায়; এবং যৌনতাকে স্বর্গীয়।
প্রকৃতিতে মানুষ ভিন্ন অন্য প্রাণীর ‘অসুন্দর’ ও ‘অস্বর্গীয়’ যৌন কর্মকাণ্ডকে এরা এলাউ করে না; বা না দেখতে পারার চেষ্টায় রত থাকে।”
স্বর্গের একমাত্র কর্মকাণ্ড যৌনতা এই চিন্তা কারা লালন করেন? কিংবা স্বর্গ বিষয়ক ধারণা তো একজন শিল্পীর আলোচনার বিষয়বস্তু নয়, যেহেতু সমূহ জ্ঞানকাণ্ড হতে উৎসরিত 'মানুষ' অস্তিত্বের ভাব তিনি লাভ করেছেন বলেই আমরা ধারণা লাভ করে থাকি। তাহলে ব্রাত্য রাইসু কতৃক দাবীকৃত 'অস্বর্গীয় যৌন কর্মকাণ্ড' বিষয়ক চিন্তা শুধুমাত্র একজন সাধারণ মানের পাঠক হতেই ওঠার কথা, কিংবা তিনি যাদের শিল্পী বলে দাবী করছেন তারা মূলত সাধারণ পাঠকই।
উপমা ও রূপক।
“অর্থাৎ প্রাকৃতিক জগতকে এরা অপছন্দ বা ঘৃণা করে। প্রকৃতিরে সৌন্দর্যে বা স্বর্গে পরিবর্তিত করা ছাড়া শিল্প বা সাহিত্যের ভিন্ন উদ্দেশ্য নাই এদের কাছে। অর্থাৎ উপমা ও রূপকই এদের সাহিত্য।”
উপমা ও রূপক বিষয়ে বলতে গেলে আমাদের বলতে হবে যে, শিল্পে মানুষের প্রাক্তন অস্তিত্ব এবং বর্তমান অস্তিত্বের সাপেক্ষ নির্মাণ করার চেষ্টা করা হয়। সেইসাথে, একজন শিল্পী এই সাপেক্ষ হতে পাঠ গ্রহণ করার পাশাপাশি মানুষের প্রচলিত অধিকাংশ মানস অভিব্যক্তির ভবিষ্যত নির্মাণকল্পে আত্মনিয়োগ করেন। তাহলে, একজন শিল্পী যা অবলোকন করেন, তার সেইসব নতুন অভিব্যক্তিসমূহ সঠিক ভাষায় ভাব প্রদান করার জন্যেই উপমা ও রূপকের সাহায্য নেয়া একান্ত প্রয়োজনীয়। ভবিষ্যত স্বর্গের চিন্তাও ধর্মভীরুতায় আক্রান্ত মানুষের, একজন শিল্পীর নয়।
যাইহোক, আলোচিত কবিতাটি সর্বমোট ৬৭ শব্দের কিছু পুনরক্তিপরায়ণ বাক্য দ্বারা নির্মিত। নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে একরৈখিক ইমেজারির ধারাবাহিক প্রবাহমানতা। খুবই সাধারণ এই ইমেজারি সম্বলিত কবিতার মূল ভাবের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখতে পাই দুইটি কাকের সঙ্গম দৃশ্যের অন্তরালে বা প্রতীকে মূলত মানব অবদমনেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। রয়েছে পূর্বোক্ত অভিজ্ঞতার সারাৎসারে নির্মিত নতুন করণীয়ের রূপকল্প; আসলে কী কোন রূপকল্পের সন্ধান পাওয়া যায় সমকামী দুইজন পুরুষের সঙ্গম দৃশ্য ছাড়া?
ইত্যকার সঙ্গম দৃশ্য বহুপূর্বেই ক্লাসিক্যাল যুগের শিল্পখণ্ডে প্রভূত পরিমানে ব্যবহার করা হয়েছে কিংবা বলা চলে যৌনতা পৃথিবীর সভ্যতাসমূহের শিল্পচর্চার আদিম উপাদান হিসেবেই বর্তমান রয়েছে। তাই, নব কোন বিধানের সন্ধান এবং ভাবের গভীরতা অ-ধারণ হেতু ইহার কোন নান্দনিক মূল্য তথা আনন্দ ও নৈশব্দের কোনটিই লাভ করা গেলনা।
আসুন, এবার আলোচিত কবিতাটির পাঠ গ্রহন করা যাকঃ-
“দোরা কাউয়া পেয়ারা গাছে কাকা করে রে
দোরা কাউয়া পেয়ারা গাছে হিঃ হিঃ কী কী করে রে
পাতা ঝরে পাতা ঝরে পেয়ারারপাতা ঝরে রে
দোরা কাউয়া পেয়ারা গাছে কু কু করে রে
দোরা কাউয়া পাতি কাকের গোয়া মারেরে
পেয়ারা গাছে পাতি কাকেরগোয়া মারে রে
ওরে আমার দোরা কাউয়া, দোরা কাউয়া রে,
পেয়ারা গাছে পেয়ারা গাছের পাতা ঝরে রে
ওরে আমার ঝরাপাতা, পাতাঝরা রে।।”
বিঃদ্রঃ- উপরোক্ত আলোচনায় কোটকৃত অংশগুলো ব্রাত্য রাইসু লিখিত ‘বাংলা কবিতায় কেন ‘দোরা কাউয়া পেয়ারা গাছে’ অতীব গুরুত্বপূর্ণ কবিতা’ নামক গদ্য হতে নেয়া হয়েছে ।
Post a Comment