মৃত্যুবরণকারী কিছু সত্য এবং মুখ খুলবার একটি গল্প | মুহাম্মদ তৌকির হোসেন

ষাটোর্ধ্ব ইসমাইল হুজুরের বিকেলবেলাটা শুরু হয় সাধারণভাবেই। যে সাধারণ অভ্যাস তাঁকে ধরে রেখেছে বিগত দশ বছর, এই মসজিদের প্রাচীরগুলোর মাঝে। প্রাচীরগুলোর সাথে ইসমাইল হুজুরের সখ্যতা বহুদিনের পুরোনো। সেই ছোটকালে যখন আমসিপারা পড়তে লুঙ্গির কোঁচা আনাড়িহাতে বেঁধে রেহেল নিয়ে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে গেট পেরুতেন তখনও যেমন গম্ভীর দৃষ্টিতে প্রাচীরগুলো তার উপর নজরদারি করত, এখনও করে। তবে সেই নজরদারির উপর সিমেন্টের পলেস্তারা, আর চকচকে বার্জার রঙ নতুনত্ব দিয়েছে। আর এই বহুদিনের সম্পর্কের চিহ্ন- প্রাচীরের গায়ে আঁকাবাঁকা, সরু, লাল পানের পিকের অস্তিত্ব। বুঝিয়ে দেয় দেয়ালগুলো, ইসমাইল হুজুরের পানের পিকই তাদের জন্যে বন্ধুত্ব। আর ইসমাইল হুজুরের পানের পিক ফেলবার অধিকারই হুজুরের জন্যে বন্ধুত্ব।

দুপুরে ভাতঘুম দেওয়ার পর শরীরটা ম্যাজম্যাজ করে তাঁর। সেই শরীরটাকে বিছানাতে রেখেই তিনি সেটাকে ডানে, বামে আধ-চরকির মতো ঘোরান। তাতে অস্বস্তি একটু কমলেও পুরোপুরি কমে না। ম্যাজমেজে শরীরটা টেনে নিয়েই তিনি উপস্থিত হন মসজিদের মাইক্রোফোনের সামনে।
এক নি:শ্বাসে টেনে টেনে সুর দেন-
"আল্লাহু- আকবার-, আল্লাহু- আকবার-..."

আযানের শেষদিকে হঠাৎ বুকের ভেতর ঘড়ঘড় করে উঠে তাঁর। শ্বাসকার্যের নলে যেন পাথর আটকে গেছে। ক্ষণিকের জন্যে তাঁর মনে হয়, 'ঈশরে আজরাইলটা যদি অহন আইতো। লই যাইতো আত্মাটা। বেহেশত এক্কেবারে নিশ্চিত।' কিন্তু অনন্তর আজরাইল আসে না, তাঁর রূহও কঙ্কালে বসে থাকে ঠিকঠাক। হুজুরের মন উথালপাথাল হয়। ঢেউ এসে পড়ে স্বাভাবিক মনোস্রোতে। মৃত্যুচিন্তা তাঁকে গ্রাস করে। বুক ফাঁপা নলের মতো হু হু করে ওঠে।

মসজিদের ইমামের পেছনের প্রথম কাতারে নামাযের মধ্যিখানে বারংবার মৃত্যুচিন্তা তাঁকে একেবারে নুইয়ে নুইয়ে দিতে থাকে। কচিডাল চির খেলে যেমনটা দুলতে থাকে, তাঁর সত্ত্বা নড়বড় করে সেভাবে দুলতে থাকে। দোয়ার সময় হাত দুইটি যথাসম্ভব উপরে তুলে দেন, 'মা'বুদ, বেহেশত দিও। বেহেশত দিও। নামায, আযানের মধ্যি মওত দিও।' মুখের ওপর তালু দুটোকে কোমলভাবে মুছে দিয়ে ঝজুভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ান তিনি।

ইমাম সাহেব, অন্যান্য মানুষগুলো নামায শেষে একে একে চলে যেতে থাকে। ইসমাইল হুজুর এক এক করে ফ্যান, লাইট বন্ধ করতে থাকেন। একটা সময় যখন পুরো ঘরটাতে থমথমে নিরবতা আনতে তিনি সক্ষম হন, বিদ্যুতকে চোখের আড়ালে নষ্ট না হবার নিশ্চয়তা তিনি আনেন, যখন দরজাটা লাগিয়ে চলে যাবেন যাবেন করছেন তবুও দরজার খিল আর লাগানো হয় না। ছানি পড়তে থাকা চোখের অস্পষ্ট সামনের দিকটা আটকে দেয় মধ্যবয়স্ক এক লোক। পরনে ময়লা আস্তর পরা চেক শার্ট, হাতা দোমড়ানো। মানুষটির দিকে এগিয়ে আসতেই ইতস্তত করে ওঠে। সেই ভঙ্গিতেই বলে ওঠে, 'ইসমাইল হুজুর কোনঠি থাহেন?'
'আমিই ইসমাইল হুজুর।'
'আসসালামু আলাইকুম।'
'ওয়ালাইকুম সালাম।'
'হুজুর, হাজিরা দেখতে আইসিলাম।'
'অহন?'
হুজুর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলেন, 'অহনও তো মাগরেব হয় নাই।'
'বহুত দূর থেইকা আইসি আমি। এক লোক আমারে পাঠাইসে। তেলিপুকুরের সাবের মিয়া। হে কইল, আপনে নাকি জ্বিন, ভুত আছর কাটাইতে পারেন, হাজিরা দেখতে পারেন, মাইনষের গায়েব গুমর কথা ফাঁস কইরে দিতে পারেন...।'
মুহূর্তেক চিন্তা করে আগত মানুষটির পরিশ্রমের কথা চিন্তা করেন। তেলিপুকুর গ্রাম এখানের না। কমসে কম চার মাইলের ধাক্কা।
প্রধান দরজার দিকে এগোতে এগোতে হুজুর বলেন, 'আইচ্ছা, আও আমার লগে।'
ইসমাইল হুজুর সুন্দরি কাঠের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেন। আর পেছনে ইশারা করেন মানুষটিকে। দুইজনে এক বিষন্ন অনুকরণে এক সারিতে হাঁটতে থাকেন। ওযুখানা পেরিয়ে, দোতলা। সিঁড়িগুলো সম্ভাষণ জানাতে থাকা শেষ বিকেলে তাদের একটু একটু করে ওপরে ওঠাতে থাকে। দোতলার শেষ প্রান্তের দরজার কাছাকাছি এক দূরত্বে তারা দুইজন দাঁড়িয়ে পড়েন। দরজার উপরে ছোট একটা কাঠের আনাড়ি কারিগরের তৈরী নেমপ্লেট-
মো: ইসমাইল হুজুর।
জ্বিন, ভুতের আছর কাটানো হয়।
বাদ মাগরিব হইতে রাত্রি দশটা।

ফোন-...
ঘরের ভেতর ঢুকতেই দেখতে পাওয়া যায় আবছা অন্ধকারে জায়গাটা ঢেকে আছে। দিনের কোন সময়ভাগে এই ঘর বর্তমান তা নির্ণয় করা মুশকিল! কাঠের পুরোনো চেয়ার সরিয়ে লাইট জ্বালেন হুজুর। বসতে বলেন আরেক চেয়ারে। নিজে বসেন টেবিলের পেছনের চেয়ারটাতে।
বলেন, 'কার হাজিরা দ্যাখবেন?'
'আমারটা হুজুর। ব্যবসাত লোকসান যাইতেসে ইদানিং । মনে অয় সৎ ভাইয়ে বাণ মারসে।'
'বাণ মারা খুব খারাপ জিনিস বুঝলা? খুব খারাপ জিনিস। সৎ ভাই হোক, আর প্যাটেরই হোক। আদম নবির দিক থেইকা আমরা হগ্গলেই ভাই ভাই।'
'দ্যাখেন না তই। কে কি কইরা রাখসে এ্যামনেই জানা যাইব।'
হুজুর টেবিলে থাকা দুইপ্রান্তে লাল কাপড় বাঁধা মরা গরুর হিউমেরাস হাড় তুলে নেন। সেটাকে ধরে খানিকসময় বিড়বিড় করে দোয়া পড়েন। তারপর সামনের কাপে লম্বা করে হাড় ঢুকিয়ে বিড়বিড়ানি পঞ্চমে চড়িয়ে দেন।
'বাপের নাম?'
'মোকলেসুর রহমান।'
খানিক সময় নিশ্চুপ স্থিতি নেমে আসে ঘরটাতে। চোখ তুলে হুজুর বলেন,
'না। বাণ টাণ না। খারাপ জিনের আছর লাগসে। কাটানো যাইব। বড় কিছু হয় নাই।'
মুখের বিহ্বলতা কেটে যেতেই ধাতস্থ হয় লোকটা।
'কী করতে হইব তাইলে হুজুর?'
'কালইয়া এক কাঁদি কলা আর এক ডিববা মধু লই আসিও। সকাল দশটাত। ওগুলা পইড়া দিমুনে।'
মানুষটি উঠে পড়ে। সালাম দেয়। প্রতিশ্রুতি দেয় আগামীকাল কলা, মধু নিয়ে আসবার। বুকের ভেতর চাপা পাথর বিচ্যুত হয়েছে তার জায়গা থেকে অনেকখানি। ভরসার একটা রশি সে আঁকড়ে ধরতে পেরেছে। চৌকাঠ পেরিয়ে মুয়াজ্জিনের ঘর ত্যাগ করে সে।
মাগরিবের নামায শেষে এই ঘরে একেবারে স্থায়ী হয়ে বসলেন ইসমাইল হুজুর। ফ্যান ফুল স্পিডে ছেড়ে দিয়ে পাঞ্জাবির বুকের কাছের বোতাম দুটো খুলে ফেললেন। গুমোট হয়ে থাকা ভেতরের বদ্ধ বাতাস থেকে হাঁপ ছাড়লেন। ভেতরে ভেতরে অশান্তি হয়। ঘরেরই বাতাস ছুটতে ছুটতে বৃদ্ধের মন দেহকে প্রশান্ত করবার চেষ্টাকে একেবারে হাতের আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে ফেলে দিতে পারেন না। মধ্যকন্ঠে বলে উঠলেন, 'আলহামদুলিল্লাহ!'
তাঁর টেবিলের সামনে দুই দুটো চেয়ার। দেয়াল ঘেঁষে আরেকটা বেঞ্চি। আর নীল দেওয়ালে লেপ্টে আছে গত বছরের পুরোনো ক্যালেন্ডার। ক্যালেন্ডারের তিন ইঞ্চি পাশে কাবা আর মদিনা ঘরের ছবি বাঁধিয়ে ঝোলানো। ঘরময় জাফরানি আতরের সুবাস। টিকটিক চলতে থাকা ঘড়িতে প্রদর্শিত হচ্ছে সাতটা।

সন্ধ্যের পর পরেই আসতে থাকে একজন, দুইজন করে অনেকজন। কারো সমস্যা বিয়েশাদি না হওয়াকে কেন্দ্র করে, কারো সমস্যা অসুস্থতা নিয়ে, কারো সমস্যা আছর কাটানো নিয়ে কিংবা বাণ... শেষ আলো দেখতে পেয়ে সংষ্কারের পাদবিন্দুকে সম্বল করে হুজুরের কাছে ছুটে আসা- পানি পড়া নেওয়া, ফুঁ নেওয়া কিংবা তামার তাবিজ সাথে আশ্বাসের বাণী। রাত ঘনিয়ে আসবার সাথে সাথে হুজুরের গরম কম বোধ হতে থাকে। ফ্যানের রেগুলেটর দুইদাগ কমিয়ে দেন। চেয়ারের উপর পা উঁচিয়ে বসেন। টেবিলের মুনশির দোকান থেকে আনা চায়ের কাপের স্তর একটু একটু করে ঠান্ডা হয়ে তলানির দিকে যেতে থাকে।
তখন, যখন আর দুইজন রূগী কেবল বাকি ঘড়িতে ছোট কাঁটা দশটার কিছু দূর এগিয়ে যায়। হুজুর বুঝতে পারলেন, এখন দোর বন্ধ করে দেবার সময়। ভাত খাবার সময়। শুতে যাবার সময়।
তাবিজ লিখে দিয়ে যখন শেষজনটির দিকে তাকালেন তিনি, একটু চমকিত হন। কিন্তু সেই চমকের ভাব সরাসরি প্রকাশ করলেন না।
শেষোক্ত মানুষটির বেশভূষা সাধারণ। লাল রঙের গার্বাডিং প্যান্ট আর সুতি শার্ট। গালে গর্ত হয়ে যাওয়া দুটি কাটা দাগ। কেউ আঁচড় দিলে যেরকম দাগ বসে যায় অনেকটা সেরকম। চেহারা অমার্জিত, রুক্ষ।
ইসমাইল হুজুর তার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'জ্বী, আপনি আসেন। আপনের সমস্যা?'
মানুষটি কুশলতার ধারে কাছে গেল না। সরাসরি বলল, 'আমি এই এলাকার আবু মেম্বারের কাছের লোক। বহু পুরানা লোক। উনি আপনের কাছে আমার সমস্যার লাইগা পাঠাইসে। আপনি নাকি হাজিরা দেইখা গায়েবের খবর দিতে পারেন?'
'জ্বী।'
'হাজিরা দেখতে কত নেন?'
'ত্রিশ টাকা। আপনের সমস্যা বলেন।'
'একটা মাইয়ামানুষেরর হাজিরা দেখতে হইব। মাসুমা আক্তার। দ্যাখেন।'
'বাপের নাম?'
'মৌলবি আবুল কাশেম।'
হুজুর সামনের চায়ের কাপের ভেতর গরুর হাড় নাড়াতে শুরু করলেন। সাথে সাথে নড়ে উঠলো তাঁর শুষ্ক, জীর্ণ ঠোঁটের কিনার। এক নাগাড়ে দোয়া পড়তে পড়তে হুজুরের চোখ বন্ধ হয়ে যেতে থাকলো আর মেম্বারের কাছের লোক অধৈর্য্য দৃষ্টিতে তাঁকে প্রত্যক্ষ করতে লাগলো।
'না। সমস্যা নাই।'
দীর্ঘক্ষণ দোয়া পড়বার পর হুজুর চোখ খুললেন।
'কী বলেন সমস্যা নাই? আবার দেখেন।'
ইসমাইল হুজুর খানিকটা অবাক হলেন। আজ পর্যন্ত কাওকে সন্দেহ নিয়ে দুইবার হাজিরা দেখতে আগ্রহী হতে দেখেন নি। এই লোকটির অতি রুক্ষ স্বভাব কর্তৃত্বমূলক আদেশে প্রতিফলিত হচ্ছে।
তবুও তিনি কিছু না বলে আবার চায়ের কাপে হাড় রাখলেন, ঠোঁট নাড়লেন, চোখ বন্ধ করলেন।
'নাহ! কোন সমস্যা নাই।' দ্বিতীয়বার হুজুর রায় দিলেন।
এবার সামনের মানুষটি ক্ষেপে উঠল, 'বললেই হইল নাকি মিয়া! এই মাইয়াডা আমার দ্বিতীয় ঘরের স্ত্রী। হেয় আমারে গত সপ্তাত দুইবার খুন করবার লাগসিল। আর আপনি কন সমস্যা নাই! হের মধ্যি জ্বীন নাই মানলাম। অন্য কেও বাণ টাণ মারসে নাকি? আবার দ্যাখেন।'
এবার হুজুর বিরক্ত হলেন। বিরক্তি চেপে গলা কেশে বোঝাবার চেষ্টা করেন,
'বাণ টাণ মারলে, জ্বীন টিন থাকলে এ্যামনেই ধরা পড়তো বাবা। দুইবার দ্যাখলাম। হেইরকম কিছুই হয় নাই।'

মানুষটি নাছোড়বান্দা। অগত্যা তৃতীয়বার হুজুর হাজিরা দেখতে বসলেন এবং পুনরায় তাঁর জীর্ণ, বৃদ্ধ ঠোঁটজোড়া সমস্যা নেই বলে রায় দিল।
মানুষটি এবার তার রাগ সরাসরি প্রকাশ করল, সম্মানের ধারেকাছে না গিয়ে।
'বুজরুকি করস? ভাবস যে আমি ধরতে পারি নাই তর চালাকি? মাইনষেরে ভড়ং দেখাইয়া টাকা কামাস আর আমি বোধঅয় চুপ কইরা থাকুম। কালইয়া তোর চাকরি যাইব। মেম্বাররে ডাইক্যা লই আনমু। দেখব তোর সমস্যা নাই এর বাহাদুরি।'
ইসমাইল হুজুরের বাম পাঁজরে কথাগুলো এসে ঠোকর খায়। ছেলের বয়সী এরকম কারও মুখে তুই তোকারি কখনও শোনেন নি। রাস্তায় হাঁটলেও তিনি নিয়মিত সালাম পেয়ে থাকেন। শেষ পর্যন্ত এই ছেলের হাতে হেস্তনেস্ত হতে হলো তাঁকে! ‘আল্লা! উঠাইয়া নাও।‘
মানুষটি সংষ্কার, অন্ধ বিশ্বাস থেকে এসেছিল। ভেবেছিল তার স্ত্রীর একটা জটিলতা ধরা পড়বেই। সে ছুতায় কাল মেম্বারকে সাক্ষী করে তালাক দিয়ে দিতে পারবে। স্ত্রীর সাথে তার বনিবনা নেই অনেকদিনের। তবে এই সকল চিন্তাভাবনা তার ভেতরেই গুমরে রেখে দেওয়া আছে সযত্নে। পুরোপুরি অবিশ্বাস করতেও তার মন সায় দিচ্ছে না। তবুও বিশ্বাসের উপর ভর করে আরেকবার পরীক্ষা করবার জন্যে নিজেকেই বেছে নেওয়া যায় কিনা সে হিসাব মানুষটি কষতে থাকল।
'আচ্ছা বাদ দেন। আমার হাজিরা দ্যাখেন। নাম শামসুর করিম। বাপ হামিদুর করিম।'
কিন্তু বলেই বুঝলো সে ঝোঁকের মাথায় ভুল জিনিস বলে ফেলেছে। তার আরও সংযত হওয়া উচিত ছিল। ইসমাইল হুজুর এই মানুষটিকে তাড়াতে বড্ড তাড়াহুড়ো করছিলেন বলেই কিনা হাজিরা দেখবেন কি দেখবেন না তাতে সিদ্ধান্ত নিতে সময় নেন নি। দ্রুত হাজিরা দেখিয়ে বিদায় করবার নিমিত্তে তিনি চায়ের কাপে হাড় নাড়াতে লাগলেন, ক্ষীপ্রগতিতে ঠোঁটও চালাতে লাগালেন।
এবং যখন তিনি চোখ খুললেন তাঁর একজোড়া বিস্ফারিত দৃষ্টি মানুষটির ওপর পতিত হলো। শামসুর করিম নামের মানুষটি তখন আপ্রাণ চেষ্টা করছেন নিজের পাংশুটে মুখবর্ণকে লুকিয়ে রাখবার।
'বাইর হ এইখান থেইকা! বাইর হ! প্রথম বউরে খুন কইরা অহন দ্বিতীয় বউরে ছাড়াইবার চাস! গতমাসের এলাকার মাইয়া মানুষটারে তুইই মারসিলি? মেম্বাররে তো খবর দেওন দরকার।'
রুক্ষ, অমার্জিত স্বভাবটি আবার শামসুর রহমানের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ে।
'এ্যাই বুড়া চুপ যা! চুপ যা কইলাম!'
'চুপ? আমারে অপমান কইরা চুপ যাইতে কস? কাইলকেই মেম্বারের কাছে যামু আমি।'
আর সংযত থাকতে পারে না শামসুর।

ঘড়িতে যখন দশটার ছোট কাঁটা আরো কিছুদূর অতিক্রম করে ফেলেছে এবং বড় কাঁটা প্রায় পনের ঘরের কাছাকাছি তখন শামসুর রহমান মুয়াজ্জিন ইসমাইল হুজুরের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সেই ঘরের দিকে এখন উঁকি দিলে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ইসমাইল হুজুর তাঁর কাঠের চেয়ারে মাথা কাত করে বসা, চোখজোড়া অপলক দৃষ্টিতে খোলা, হৃদপিন্ড আর কোন সাড়া প্রদান করছে না। দেখা যাচ্ছে ইসমাইল হুজুরের আযান কিংবা নামাযরত অবস্থায় মৃত্যুর দোয়া কবুল হয় নি। চিন্তার বিষয়- ইমাম সাহেব আগামীকাল সকালে ফজরের আযান শুনতে পাবেন কি না।
তবে এতটুকু নিশ্চিত যে ইসমাইল হুজুর শ্বাসরোধে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং তার সাথে সাথে মৃত্যুবরণ করেছে কিছু সত্য এবং মুখ খুলবার একটি গল্প । 

No comments