আই স্মোক টু জয়েন্টস | নাজমুস সাকিব রহমান


গুলজার মোড় থেকে কলেজ রোডে পা দিতেই —
গুলজার মোড় থেকে কলেজ রোডে পা দিতেই জাহিদের সামনে পড়ে গেলাম। জাহিদ এমন একটা জিনিস, যার সঙ্গে একবার বসে গেলে সহজে উঠা যায় না। দুনিয়ার এমন কোনো কিছু বাদ নাই, যা নিয়ে সে কথা বলে না। আজও বলবে। বকর বকর করে মাথা ধরিয়ে দেবে। না হলে সে নিজেই শান্তি পাবে না।
আজ অবশ্য দিনটা একটু আলাদা। একটু ভুল হল, দিন না, বলা উচিত রাত। সন্ধ্যা পার হয়েছে অনেকক্ষণ। আমি ঘর থেকে কাজ নিয়ে বের হয়েছি। সাধারণত আমি কাজকর্ম কিছু করি না। অনার্স পাস করার পর থেকে বেকার থাকতেই ভালো লাগে। আজও বেকার ছিলাম। কিন্তু বাসায় মেজো খালা আসাতে একটু ব্যস্ততা চলে এল। আমার এই খালা যাকে পায়, তাকেই কাজ দিয়ে ব্যস্ত করে দেয়। শিঘ্রই এর থেকে মুক্তির উপায় বের করতে হবে।
‘ওই শফিক, কই যাবি?’ জাহিদ জিজ্ঞেস করে।
আমি উত্তর দিই, ‘একটা কাজ আছে। এখন আড্ডায় জয়েন করতে পারব না। কাজ শেষ করে আসছি।’
‘জয়েন না করলে করবি না। অন্যরা মনে হয় এখনও আসে নাই। ওরা আসা পর্যন্ত বস।’
আমি জাহিদের কথায় রাজি হই। নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বসে পড়ি। সত্যিই কেউ আসেনি। তারপরেও শান্তি পাই না। একটু পরপর জাহিদের মোবাইলে রিং হচ্ছে। ওর রিংটোনে বব মার্লের গান সেট করা আছে। এইজন্য যতবারই রিং হচ্ছে, বব মার্লে গেয়ে উঠছেন — ‘আই স্মোক টু জয়েন্টস।’
আমি সাজেশন দিই, ‘ফোনটা দূরে ছুঁড়ে মার' 
জাহিদ রাজি হয় না। বলল, ‘এরচেয়ে সাইলেন্ট অপশনটা ভালো, কী বলিস?
আমি একমত হলাম না। বললাম, ‘কল রিসিভ করলে সেটাও তো করতে হয় না।’
জাহিদ হাসল। বিবিএ কমপ্লিট হওয়ার পর থেকে সে এইরকম হাসি দেয়। প্রায় সময়, এই হাসির অর্থ বোঝা যায় না। বলল, ‘তোর কী কাজ আছে বললি না?’
আমি বলব না ঠিক করেও বললাম, ‘মিসকিন শাহ (র:) মসজিদে যাবো।’
‘ওখানে কি কাজ?
‘মেজো খালা পঞ্চাশটা টাকা দিয়েছেন। মসজিদের বাক্সের ভেতর দিয়ে আসতে হবে। আরো বলেছেন, কাজ শেষ করেই যেন তাকে জানাই।’
‘একটা কাজ কর। টাকাগুলা তুই নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ফেল। তারপর উনাকে ফোন করে বল, খালা, টাকা জায়গামত পৌঁছে দিয়েছি। আমি তো তোর চেয়ে গরীব কাউকে দেখি না।’
আমি হেসে ফেলি। বলি, ‘লাস্ট-বার এই কাজ করেছি। এবার আর করা যাবে না। খালা জানতে পারলে রাগ করবে। সামনে উনার ছেলের পরীক্ষা।
‘জানবে কীভাবে? মিথ্যার ওপর থাকবি। আমি তো মিথ্যা ছাড়া কথাই বলি না।’
‘মিথ্যা তো বলাই যায়। কিন্তু হুট করে একবার সত্য বেরিয়ে গেলে সব এলোমেলো হয়ে যায়। তখন সামাল দেয়া আরেক পেইন।’
‘ পেইনকে এঞ্জয় করতে শিখ। আর কদ্দিন? মাজারে টাকা দিলে কারও রেজাল্ট ভালো হয় না।’
‘মনে করিয়ে দেয়ার জন্য থ্যাংকস। আমি উঠছি। কিছুক্ষণ পর আর যেতে ইচ্ছে করবে না। এগুলা বিশ্বাসের ব্যাপার। আরেকজনের বিশ্বাস ধরে টানাটানির কিছু নাই। তুই বস। আমি একটু পর আসব।’
‘ঠিক আছে যা।’ এতোটুকু বলেই জাহিদ এতক্ষণ ধরে রিং হতে থাকা কলটি রিসিভ করে। তারপর এক নাগাড়ে বলে চলে, ‘হ্যাঁ ভাইয়া, আমি তো আজকে আসতে পারব না। জানি তো, সুমাইয়ার কালকে পরীক্ষা, কিন্তু কী করব বলেন? একটা জরুরি কাজে আটকা পরছি। ফ্রি হতে অনেক সময় লাগবে।’
আমি চলে আসতে-আসতে জাহিদের কথা শুনি। হাসি হাসি ভাব ধরি। ভাবি, এই ছেলে তো মোবাইল ফোনে মিথ্যা কথার বাজার বসিয়ে দিয়েছে।
আজকে মনে হয় কেউ আসবে না। আমি না আসা পর্যন্ত জাহিদকে একাই বসে থাকতে হবে। বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে একা বসে থাকাটা কষ্টকর কাজ। আমার মাথায় দুষ্টামি করার একটা আইডিয়া আসে। আমি জাহিদকে ফোন করি। সে রিসিভ করেই বলে উঠে, ‘তুই না দেখলি টিউশনি একটার যন্ত্রণায় ফোন ধরতেছি না। ফোন করলি কেন?’
আমি বললাম, ‘সুমাইয়ার পরীক্ষা ভালো হওয়ার জন্য দানবাক্সে কয়েকটা টাকা দিয়ে দিব?’ জাহিদ কিছু বলল না। সঙ্গে সঙ্গে ফোন রেখে দিলো।
আমি মিসকিন শাহ (র.) মসজিদের দিকে রওনা দিই। বেশিদূর এগুতে পারি না। তার আগেই এক মহিলাকে দেখলাম। ছোট একটা বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আমাকে ডাকলেন। আমি কাছে যেতেই বললেন, ‘বাবা, মাইন্ড করো না। আমার বাচ্চাটার খিদে পেয়েছে। আমার কাছে টাকা নাই। তুমি কিছু খাওয়াতে পারবে?’
আমি রাজি হই না। মাইন্ড শব্দটার ব্যবহার নিয়ে কিছু ভাবার আগেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, ‘আমার পকেটও খালি। আপনি অন্য কাউকে বলেন।’
আমার পকেট খালি কথাটা সত্য। কিন্তু পুরো সত্য না। মেজো খালার দেয়া পঞ্চাশ টাকার নোটটা তো ছিল। চাইলে ওটা দিয়ে দেয়া যেতো। কিন্তু ততক্ষণে জায়গাটা পার হয়ে গেছি। ব্যাপারটা মাথায় আসায় একটু মন খারাপ হয়।
আমি দ্রুত ভাবনা বদলে ফেলি। মাথা পিছু হাজার ডলারের ওপরে যে দেশের মানুষের আয়, সেই দেশে এক ভাবনা নিয়ে বেশিক্ষণ পরে থাকা যায় না। আমিও থাকলাম না। মেজো খালার দেয়া কাজ শেষ করলাম। দানবাক্সের ভেতর ওই পঞ্চাশ টাকা ফেলতেই নিজেকে হালকা মানুষ মনে হল।
দায়িত্ব পালনের পর মেজো খালাকে ফোন করার কথা ছিল। এটা জেনেও আমি ফোন দিলাম না। উনার নাম্বারে মেসেজ করলাম। লিখলাম, ‘মিশন সাকসেসফুল।’ এখন কাউকে মেসেজ দেয়া বেশ সাহসের ব্যাপার। সিম কোম্পানিগুলা এতো বেশি মেসেজ পাঠায় যে, মানুষ মেসেজ চেক করে না। না পড়ে রেখে দেয়। এসব জেনেও আমি মেজো খালাকে মেসেজ দিলাম।
‘তোমার ঠোঁট এতো লাল কেন?’ আমার কথা শুনে জাহিদ হাসল। তার হাসি দ্য ডার্ক নাইটের জোকারের মত। আধা ঘণ্টা আগেও জাহিদের ঠোঁট লাল ছিল না। আমি যাওয়ার পর হয়েছে।
জাহিদ বলল, ‘শেভ করতে গিয়েছিলাম।’
আমি বললাম, ‘তুই শেভ করা যা, না করাও তা। এখন বল, ঠোঁট লাল হল কীভাবে? লিপস্টিক দিয়েছিস?’
‘আরে না। বিশাল কাহিনী।’
‘একটু ছোট করে বল। শুনি।’
‘তুই যাওয়ার সময় ছাত্রীর বাবা ফোন করেছিলেন। উনাকে বললাম, আংকেল, আমি তো জরুরি কাজে আটকা পড়ছি।’
‘জরুরি কাজ করছিস, এটা ফিল করার জন্য সেলুনে গিয়েছিস?’
‘হ্যাঁ। গিয়ে দেখি, নতুন এক ছেলে এসেছে। হাত এখনো শার্প হয় নাই। অনেক সময় লাগছে।’
‘পেইনকে এঞ্জয় করিস নাই?’
‘করতে চাইছিলাম। শেষ পর্যন্ত পারি নাই। শেভ শেষে মুখ ধুয়ে দিবে। চোখ বন্ধ অবস্থায় বেসিনের সামনে মুখ নিলাম। একটু পর দেখি, ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা। তুই বল, শীতকালে এসব ভালো লাগে?’
‘না। একটু বরফ-বরফ লাগে আর কী।’
‘জেল শেভ করেছি তো, এই জন্য আরও বেশি ঠাণ্ডা লাগছিল। মনে হচ্ছিল, মুখটা বরফ হয়ে যাচ্ছে।’
‘দোকানের মালিককে কিছু বলিস নাই?’
‘বলেছি। ওদের বর্তমান মিটারে নাকি কী একটা ঝামেলা আছে। পানি গরম করতে দিলেই মিটার বন্ধ হয়ে যায়। সামনে মিটার বদলাবে। তখন গরম পানি থাকবে।’
‘ততদিনে শীতকাল শেষ হয়ে যাবে। কোনো লাভ নাই।’
‘আমিও এটাই বলতে যাচ্ছিলাম। তখনই — ’
‘তখনই কি?’
‘তখনই ঠোঁটটা লাল হয়ে গেলো।’
‘মানে কী? হুট করে একজন স্মোকারের ঠোঁট লাল হয়ে গেলো?’
‘তাই তো ঘটল। দোকানের মালিককে গরম পানি নিয়ে বলাতে, সে নতুন ছেলেটাকে ইশারায় বলে দিল, শীতকালে ঠোঁট ফেটে যায়। আমাকে যেন একটু লিপজেল লাগিয়ে দেয়।’
আমি বলি, ‘ব্যবস্থাটা ভালোই। কাস্টমাররা খুশি হবে। গরম পানি নাই, কালারফুল লিপজেল তো আছে!’
জাহিদ বলল, ‘একদিক থেকে ঠিক আছে। আমাকে যখন লিপজেল লাগিয়ে দিচ্ছে, আমি তখন বললাম, লিপস্টিক নাই? ওরা জানাল, নাই। না হলে লিপস্টিকই লাগাতাম।’
আমি বললাম, ‘লিপস্টিক মেয়েদের জিনিস।’
জাহিদ নিজের ঠোঁটে আঙ্‌গুল বোলাতে বোলাতে বলল, ‘তোকে কে বলছে এটা? শাকিব খানের সিনেমা দেখছিস? বাংলাদেশের অর্ধেক লিপস্টিক তিনি ব্যবহার করেন। আর মেয়েরা তো আমাদের জিন্স প্যান্ট পরা ছাড়ে নাই। আমি কেন ছাড়বো?’
আমি বললাম, ‘যা, এরকম হয় নাকি?’
জাহিদ বলল, ‘হবে না কেন? হয়।’
আমিও জানি হয়। হয় বলেই গল্পটা গুলজার মোড় থেকে কলেজ রোডে পা দিতেই ড্যাশ পরে থেমে যায়। জয়েন্ট ধরানো পর্যন্ত পৌছাতে পারে না।

No comments