অবশেষে | উপল বড়ুয়া

আজান আলী বিছানায় কাশতে কাশতে তেলে পড়া কৈ মাছের মতোন বাঁকা হয়ে গেলো। এত কাশার পরও বেচারা গলায় আটকে থাকা কফটা যখন পুরোপুরি বের করতে পারলনা তখন হাঁফাতে হাঁফাতে সে চৌকির নিচ থেকে চিলমচি টেনে গাল ভরা কফ ফেলে। তারপর বালিশে মাথা রেখে শরীর টান করে বাঁ হাতে মাবিয়া বানুকে ধাক্কায়। ‘বানু, এই বানু বুকে একটু তেল মালিশ করে দিবা?’ আজান আলী যতই মাবিয়া বানুকে ডাকতে থাকে; বানু ততোই গভীর ঘুমের ভানে পড়ে থাকে। তার নাক ডাকা ঘনতর থেকে আরও ঘনতর হয়। আজান আলী তেল মালিশের কোন সম্ভাবনা না দেখে বানুকে তর্জনীতে কিছুক্ষণ গুতায় তারপর একটা দীর্ঘ বাষ্প ছেড়ে পাশ ফিরে। অথচ যখনই তার একটু চোখে তন্দ্রা নামে অমনি শুরু হয় গলায় খুসখুসানি। গলায় আটকে থাকা কফটা বের করার জন্য সে আগের
চেয়ে আরও জোরে কাশে। এবার মাবিয়া বানু কিন্তু আর ঘুমের ভানে পড়ে থাকতে পারে না। চেঁচিয়ে ওঠে- ‘ঘুমাতে দিবা না নাকি?’
মাবিয়া বানুর ধমকে হোক বা তার জোরে কাশার বাহাদুরিতায়- খুসখসে কাশি বন্ধ হয়। তখন আজান আলী অভিমানের ভাঙা সুরে বলে ওঠে- চেঁচাচ্ছো কেন? সাধে কি কাশি?’

মাবিয়া বানু চুপ করে থাকে। এত রাতে ঘুমের ব্যাঘাতে সে এমনিতে বিরক্ত। বুঝা যাচ্ছে আজ বাকি রাতটুকু তার নির্ঘুমে যাবে। একবার ঘুম ভাঙলেই সে আর দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না। বুড়ার কাশি আর তার ঘুমের জ্বালা। বালিশের নিচে নেমে আসা মাথা ঠিক করতে করতে সে খেয়াল করে
আশি কেজি ওজনের শরীরটা তার পুরোপুরি ঘামে ভেজা। গরম থেকে রেহায় পেতে সে বুক থেকে আঁচলটা ফেলে দিয়ে ব্লাউজের বোতাম তিনটা খোলে দেয়। আর এতে মাবিয়া বানুর মনে জাগে- বুড়ো বোধহয় অন্ধকারেও তাকে দেখতে পাচ্ছে। খেয়াল করে ইয়াকুব আলীর লুঙ্গি লজ্জা পর্যন্ত গুটানো এবং পরম যত্নে  বাম পা খানি বানুর শরীরে তুলে দিয়েছে । আর ঘর্রঘর্র শব্দে নাক ডাকছে। নিজ শরীরে আজান আলীর চিমসে চামড়া কুচকানো পা দেখে মাবিয়া বানুর সমস্ত রাগ ভর করে হাতে। এক ঝটকায় সে শরীর থেকে ছিটকে ফেলে দেয় পা-খানি। ‘মরার বুড়া মর’ গজগজিয়ে রাতে ঘুমানোর আগে মুখে পুরা পানটি আবার চিবাতে থাকে।

রাত এখন কত কে জানে। আজান আলীর বাঁকানো শরীর গভীর ঘুমে। মাবিয়া বানুর চোখ ঘুমহীন। মোটা হওয়ার থেকেই তার অনিদ্রা রোগ শুরু। পাশের রুমে হঠাৎ মৃদু খচখচানি শুনে সে কান সজাগ করে। কয়েক সেকেন্ড পর দেখে রুমের লাইট জ্বলতে। এরপর স্যান্ডেলের শব্দ। বাথরুমের বালতিতে পানি পড়ার আওয়াজ তার ঘুমকে আরও ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে জায়গায় জায়গায় ছড়িয়ে দেয়। এই বিচ্ছিন্ন ঘুম শত খোঁজাখুঁজির পরও লাগানো অসম্ভব। সুতরাং সে পানটাকে আরও জোরে চিবাতে থাকে।

তারপর পানির কল অফ হয়ে গেলে সে শুনে গুনগুন কথাধ্বনি। মাবিয়া বানু বন্দুকের মতো কান তাক করে গুপ্ত কথা শুনার জন্য। কিন্তু একটি শব্দও সে আবিষ্কার করতে পারেনা। এই অজানা অস্থিরতার ভেতর মাবিয়া বানুর একবার ডাকতে ইচ্ছে করে- ‘সুরাইয়া, এই সুরাইয়া ঘুমাস নাই?’ না, থাক। জামাই বাবাজি আবার কি না কি মনে করে। এসব ভাবতে ভাবতে সে খেয়াল করে সুরাইয়াদের রুমের লাইট অফ হয়ে যেতে। এত রাত করে ঘুমানোর কি দরকার তাদের? জামাইতো কালভোরেই রওনা দিবে ঢাকা। রাত করে ঘুমালে কী বেচারা ভোরে ওঠে রওনা দিতে পারবে? তার মেয়ের জামাই এবার বাড়ি এলো প্রায় তিন মাস পর। গত ছুটিতে তো অসূখের নামে তিনদিনের ছুটিকে পাঁচ দিন বানিয়ে গেলো। মাবিয়া বানু এসব বুঝে। যুবতী বউকে একলা ফেলে কী দূরদেশে মন টেকে? এই যে সুরাইয়ার আব্বা আজান আলী; বছর সাতেকে দেশে আসত দু’বার। দুই ঈদে। থাকত কি থাকত না; অমনি যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠত। বানুর ইচ্ছে হতো আজান আলীর কোমরে গামছা দিয়ে আরও দুইটা দিন বেঁধে রাখে।

এখনতো আজান আলী দিনরাত ঘরে বসে বসে কাশে। কোথাও বের হতে বললে গোঁ ধরে। জোয়ান কালের ঘরবিমূখ আজান আলীর এমন অভ্যাস দেখে বানুর পিত্তি জ্বলে। সকাল-সন্ধ্যা বুড়োকে মুখে ঝাটা মারা তার এখন নৈমত্তিক ব্যাপার। পুরুষ মানুষের আবার ঘর কি? যে আজান আলীর জন্য তার বিনিদ্রা রজনী কাটত সেই আজান বুড়ো এখন তার দু’চোখের বিষ। জোয়ান কালে না পারল সূখ দিতে আর এখন এলো সূখ নিতে। তখনকার আজান আলীর ঘরবিমূখ স্বভাবটা এই বুড়ো বয়সে যেনো মাবিয়া বানুর মগজেও ছড়িয়ে পড়েছে।

গত ঈদে যখন সুরাইয়ার জামাই তিনদিনের ছুটি পাঁচদিন বানিয়ে গেলো; মাবিয়া বানু সুরাইয়াকে ধমক দিয়ে বলেছিল- ‘পুলাডারে ছাইড়া না দিলে একদিন দেখবি চাকরি বাকরি গেছে। তখন না খাইয়া রাস্তায় নামবি।’ সুরাইয়া এই কথা শুনে ভেংচি কাটল। ‘আমি কি তারে বাইন্ধা রাখছি? সেইতো যাইবার চাইনা।’ পুনরায় সুরাইয়াদের রুমে লাইট জ্বলতে দেখলে এবং কল ছাড়ার শব্দে মাবিয়া বানুর সমস্ত অতীত ভাবনার তার ছিঁড়ে যায়। আরও কিছুক্ষণ পর মাবিয়া বানুর রুমের দরজায় কটকট আওয়াজ হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে- ‘আম্মা আপনের জামাই চলে যাচ্ছে।’

মাবিয়া বানু তার আশি কেজি ওজনের শরীরটা টেনে পালংকের নিচে নামায়। চিলমচি টেনে চিবানো লাল পান ফেলে। শরীরের কাপড় ঠিক করে দরজা খোলে। ‘কয়টা বাজে সুরু?’ -সাড়ে পাঁচটা। ছয়টায় বাস।’ জামাইকে দেখে মাবিয়া বানু শরীর জড়োসড়ো করে দরজা ধরে দাঁড়ায়। আজান আলীর ঘরবিমূখ স্বভাব- সুরাইয়ার এলোমেলো চুল- জামাইয়ের চোখে ভাসা ঘরে থাকার আকুতি ও ঘুমঘোর মাবিয়া বানুর মন উল্টেপাল্টে মোচড় মারে। ঢেউ তোলে। ঘাড় থেকে মাথায় দু’ ইঞ্চি কাপড় টেনে কদমবুসি করতে আসা জামাইকে সে বলে- ‘পারলে আরেকটা দিন থেকে যাও বাবা।’

No comments