অসম্পূর্ণ | মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল ওয়ালী


"সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে"- এই জাতীয় লাইন একটা গল্প শুরু করার জন্য মোটামুটি পারফেক্ট । কিন্তু লাইনটা আসাদ সাহেবের ঠিক মনে ধরছেনা, মনে ধরার কথাও না । আসাদ সাহেবের মনে হতে লাগলো জগতের বেশিরভাগ গল্পের কোথাও না কোথাও " সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে" লাইনটি খুঁজে পাওয়া যাবে । নিজের ওপর বেশ রাগ হতে লাগলো তার । সিগারেট ধরাতে ধরাতে তিনি ভাবতে লাগলেন শেষ কবে তিনি একটি সম্পূর্ণ গল্প লিখে শেষ করেছিলেন । মনে করতে করতে তিনি বছর দু'এক দূরে চলে গেলেন । ওই সময় তার 'ঈশ্বর অথবা সময়' শিরোনামের লিখাটি বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিল । একটি মাসিক পত্রিকায় প্রায় নিয়মিত তার লেখা ছাপানো হতো, 'ঈশ্বর অথবা সময়' এর পর তার আর কোন লিখা পায়নি ওই পত্রিকাটি । পত্রিকার সম্পাদক সাহেব লিখা পাঠাবার জন্যে আসাদ সাহেবকে বেশ কয়েকবার তাগাদা দিয়ে শেষমেশ ব্যর্থ হয়ে আসাদ সাহেবের সাথে যোগাযোগ একপ্রকার বন্ধই করে দিয়েছেন । আসাদ সাহেব অবশ্য এসব নিয়ে ভাবার সময় খুব একটা পান না । শুধু এসব নিয়ে না, চাকরিটা শুরু করার পর থেকে তিনি নিজেকে নিয়ে ভাবার সময়ই পাচ্ছেন না, পাচ্ছেন না নিজেকে দেয়ার মতো কোন সময়ও ।

আসাদ সাহেব চাকরিটা করছেন প্রায় দেড় বছর ধরে, চাকরিটা শুরু করার পর আজই প্রথম তিনি আবার কিছু একটা লিখার চেষ্টা করছেন । কিন্তু কিছুই জমছেনা । জমবে তো পরে, জমার মতো কিছু হচ্ছেও না । মাথায় না আসছে কোন গল্প, না আসছে কোন প্লট, না কোন লাইন না একটা শব্দ ! কিছুই না । লিখতে গিয়ে এই ধরণের সমস্যা হয়ে থাকে, কিন্তু তা এতটা গুরুতর পর্যায়ে যায়নি কখনোই ।

আসাদ সাহেব ব্যাক টু ব্যাক আবার সিগারেট ধরালেন । চাকরি খুঁজতে খুঁজতে হতাশ হয়ে পড়ার দিনগুলোর কথা মনে পড়তে লাগলো তাঁর । নিজেকে তার এই মুহূর্তে সেই দিনগুলোর চেয়ে আরও বেশি অসহায় মনে হতে লাগলো । ধোঁয়ার কুন্ডলী পাকাতে পাকাতে তিনি ভাবতে লাগলেন তার মরচে ধরা স্বপ্নগুলোকে নিয়ে, মানুষ নিয়ে, জীবন নিয়ে, জীবনের লক্ষ্য নিয়ে ।
জীবনে আমাদের লক্ষ্যটা কি আসলে ? ‘আমার জীবনের লক্ষ্য’ হিসেবে আমরা ছোটবেলায় নানারকম রচনা লিখে এসেছি এবং রচনার ওইসব লক্ষ্যের সাথে জীবনের লক্ষ্যের মিল খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায়না বললেই চলে । আদতে আমাদের মূল লক্ষ্যটা কি ? বেঁচে থাকা ? নাহ, আসাদ সাহেবের অন্তত তা মনে হয়না । কেননা ঠিক বেঁচে থেকেও আমাদের হয়না । আমরা আরও কিছু চাই; এমন কিছু একটা যেটা আমাদের প্রতিদিন একটু একটু করে জীবন দেখায়, জীবন-দর্শন শেখায়, জীবনের গল্প লেখায় । মোট কথা বেঁচে থাকার পরেও সত্যিকার অর্থে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে ।

‘বেঁচে থাকার পরেও বেঁচে থাকা’ এই ব্যাপারটা আসলে কী ? ভাবতে ভাবতে আসাদ সাহেবের চোখ বন্ধ হয়ে আসে, চোখ খোলা রেখে ভাবাভাবি ঠিক জমে ওঠেনা ।
আচ্ছা, সুস্থ-স্বাভাবিক দেহ নিয়ে বেঁচে থাকার পরেও কী একজন মানুষ নিজেকে ‘জীবিত’ দাবি করতে পারেন ? আসাদ সাহেবের ধারণা, এই প্রশ্নের উত্তর সেই মানুষটিই খুব সহজে দিয়ে দিতে পারবেন যিনি কি না একটা স্বপ্নের পেছনে ছুটতে গিয়ে মরে গেছেন, অথচ এখনো সুস্থ-স্বাভাবিক দেহ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন একজন জীবিত মানুষের মত অভিনয় করতে করতে । এই মানুষটা জীবিত থেকেও বেঁচে নেই । তার দেহ আছে, দেহে প্রাণ আছে, সেখানে স্পন্দন আছে । তার পরিবার আছে, সেই পরিবারে তার নানারকম পরিকল্পনাও আছে । তবু কিছু একটা যেন নেই, যেটা তাকে সত্যিকার অর্থে বাঁচিয়ে রেখেছিল, তাকে জীবন দেখিয়েছিল, জীবনের দর্শন শিখিয়েছিল ।
কি সেটা ? একটা স্বপ্ন ! দু’চোখ ভরা আগুন ! নাকি দু’টো ডানা ! যাতে ভর করে সে উড়তে চেয়েছিল । হাজার বছর ধরে চলে আসা কিছু তথাকথিত রীতি আর নিয়মের ফাঁদে আটকা পড়ে হাজারো মানুষের এরকম ডানা কাটা যায়, তারও গেছে । তার আর ওড়া হবেনা কখনো । সে এখন আর জীবন দেখেনা, জীবনের বাঁকে বাঁকে সে কেবলই মৃত্যু খুঁজে পায় ।
আসাদ সাহেব আবার নিজেকে প্রশ্ন করেন । তাহলে বেঁচে থাকার সেই অবলম্বনটাই কি ‘স্বপ্ন’ নামে পরিচিত ? না, ঘুমের ঘোরে দেখা সেই স্বপ্ন নিশ্চয়ই নয় ! ঘুম কেড়ে নেয়া সেইসব স্বপ্নগুলো । আমাদের প্রায় সকলেরই এমন ঘুম কেড়ে নেয়া কোন না কোন স্বপ্ন থাকে । এইসব স্বপ্নের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা বেঁচে থাকার আনন্দটা উপলদ্ধি করতে পারি । এই স্বপ্নগুলোই আগুন জ্বালিয়ে রাখে আমাদের দু’চোখে । বেঁচে থাকার স্বার্থে হলেও এই স্বপ্নগুলোকে কখনোই হারাতে দেয়া যায়না । এই আগুন কোনভাবেই নিভতে দেয়া যাবেনা, অন্যথায় শিখে রাখতে হবে ডানা কেটে যাওয়া সেই মানুষটি কীভাবে জীবিত মানুষের মত অভিনয় করতে করতে ঘুরে বেড়ায় । আসাদ সাহেব চোখ খুলে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়লেন । অভিনয় নামক ব্যাপারটা তিনি খুব একটা পারেন না ভেবে আবারও বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন ।

No comments