এলোমেলো স্বপ্ন | একরামুল হক শামীম


এই উঠবা নাকি গায়ে হানি ঢালুম।
আজ শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাওয়ার কথা, এখনও ঘুমাচ্ছ কেন?এই! উঠবি নাকি পানি ঢালুম। বসন্তে বেড়াতে নিয়ে যাবে বলেও ফাঁকি দিয়েছ! তাড়াতড়ি উঠ।

ছোটকাল থেকে স্বপ্ন ছিল কোনো বিদেশিইনী বিয়ে করে বাঙালীকে আরেকবার সংকর জাত উপহার দিব। এই প্রতিশ্রুতিতে আমাদের পাশের রাষ্ট্র নোয়াখাইল্যার এক নোয়াখাইল্যানীকে বিয়ে করেছি। আমাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় তিনবছর। দুজনেই একটি চ্যানেলের সাংবাদিক হিসাবে আছি।

আমাদের পরিচয় হয়েছিল খুব অদ্ভুদ ভাবে। অর্নাস- মাস্টার্স শেষ করে চেন্নাইয়ের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ নিয়ে গিয়েছিলাম সাংবাদিকতার উপরে একটি কোর্স করতে। আমাদের প্রতিদিন সকাল বিকাল ভারতকে গালি দিতে না পারলে পেটে ভাত হজম হয়না কিন্তু চিকিৎসার জন্য, উচ্চ শিক্ষার জন্য ভারত সবচেয়ে বেশি পছন্দের। মাস্টার্স শেষ হয়েছে চাকরি বাকরি করতে হবে আর এদিকে বাড়ি থেকে বিয়ে করারও তাগিদ দিচ্ছে। ইচ্ছা ছিল চেন্নাই গিয়ে কোর্সটি শেষ করে এক ফরেইনার বিয়ে করে মিডল রাষ্ট্রে স্যাটেল হয়ে যাব। আমরা প্রত্যেক দিন সরকারকে গালি দিই, রাষ্ট্রের উচ্চ পদে ভারতীয়দের চাকরি দিয়েছে তাই। আমার এটা খেয়াল করিনা, এই পদে বসার জন্য দেশে তেমন যোগ্য সম্পন্ন ব্যক্তি নেই। যারা যোগ্য তারা বাইরের রাষ্ট্রে চলে যায়। ধরেন, খুশিতে, ঠ্যালায়, ঘোরতে এই গযবটি (কোর্স) কাঁধে নিয়েছিলাম, কি গযব এই বিষয়ে পরে বলছি।

ভার্সিটিতে কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। প্রথম প্রথম স্যারদের অমায়িক ব্যবহার, বন্ধু সুলভ আচরন। নতুন নতুন সুন্দরী বান্ধুবী। প্রত্যেক দিন এনজয় করতেছি। ফরেনার সুন্দরীদের বলি স্বপ্নের কথা, তারা শুনে হাঁসে। আমাদের কোর্সে পাশের রাষ্ট্র নোয়াখালীর একজন মেয়ে ছিল। দেশীয় মেয়ের প্রতি তত ইন্টারেস্ট ছিল না, তাই তেমন পাত্তাও দিচ্ছি না। ফরেইনারদের সাথে ঘুরি-ফিরি বিয়ার-বিড়ি টানি।

কয়েক সপ্তাহের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি কেজি স্কুলের মতো আচরন শুরু করলো। সপ্তাহে ৫ দিন ক্লাস, ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে বাঁশ। মাসে একবার প্রত্যেক বিষয়ে অ্যাসাইমেন্ট, মাসে একবার ক্লাস টেষ্ট, দুই মাসে একবার মিডটার্ম হবে আবার চারমাসে ফাইনাল শুনে মাথা ভন ভন শুরু করলো। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী বাতিল করে চলে গেল নিজেদের দেশে। দু-টানায় আমি রয়ে গেলাম।

কয়েকদিন পর নোয়াখাইল্যা মেয়েটির প্রতি দূর্বলতা অনুভব করতেছি। গুরুজন বলেছেন, কেউ কেড়ে না নিলে; নিজে কেড়ে নিতে চেষ্টা করো। আমি যেমন বিদেশী মেয়ের লোভ করে গিয়েছিলাম অনেক বিদেশী ছেলেও একই লোভ নিয়ে আসতে পারে। তাই সরাসরি কবিতাকে মনে কথা বলে দিলাম। মেয়েটির নাম ছিল কবিতা। শুনে না করে দিল, বলল আমি পড়তে এসেছি আর আমার বয়ফ্রেন্ড আছে, হ্যাঁ তুই তো আবার বিদেশী মেয়ে বিয়ে করবি, আমার পিছু লেগে রইলি কেন?
-শোন মেয়ে, আমি তোমার বাপেরও বড় তুমি বা আপনি করে বলবি। আর তুমি তো আমাদের পাশের রাষ্ট্র নোয়াখালীর মেয়ে সে হিসাবে বিদেশী। মুখটি বাঁকা করে কপাট রাগ দেখিয়ে হন হন করে চলে গেল মহারাণী। এই ভাবে দিন যেতে লাগল। স্যারদের বকা, প্রক্টর রুমে ডেকে গালি নিত্যদিনের সঙ্গি। এই দিকে আমি পড়ে রইলাম মেয়েটির পিঁছু। পাক্কা ছয়মাস পিঁছু ঘুর ঘুর করে রাজি করালাম। দেড় বছরের কোর্স মেয়েটি সময়মতো শেষ করে দেশে ফিরে এল আর আমি এলাম আরও ছয়মাস পর। মেয়েটি দেশে ফিরে একটি চ্যানেলে সংবাদ পাঠিকা হিসাবে যোগদান করলো। আমিও দেশে ফিরে একই চ্যানেলে যোগদান করলাম।

ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দু'বছর লেগে গেলেও অনেক কিছু অর্জন করেছিলাম যা কখনও ভুুলে যাওয়ার মতো ছিল না। সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষকে রাজি করিয়েছিলাম চার মাসের সেমিস্টার ছয় মাসে নিয়ে যেতে। উনাদের বলেছিলাম, স্যার দেখেন সবাই উচ্চ শিক্ষা নিতে এখানে আসে। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ, সবচেয়ে বড় কথা এই বয়সে পড়াশোনার এত চাপ, এত নিয়ম কানুন মানা অসম্ভব। কতৃপক্ষ রাজি হয়েছিল আমাদের প্রস্তাবে।
আমি দেশে ফিরলে মেয়েটি অনেক কষ্টে তার পরিবারকে রাজি করালো আমাদের বিয়ের বিষয়ে। এদিকে আমি কিছুতেই রাজি করাতে পারছিলাম না নিজের পরিবারকে। ভইঙ্গা মেয়ে বউ করবে না, ভইঙ্গা মেয়ে প্রাণ খুলে তাদের সাথে কথা বলতে পারবে না। চট্টগ্রামের মানুষ সহজে আউট ডিস্টিকের সাথে আত্মীয়তা করতে চায় না। গ্রামের মানুষ একদমই করতে চায় না, আমি গ্রামের যৌথ পরিবারের ছেলে হিসাবে একেক জন একেক কথা বলা শুরু করলো।
আমি বললাম, ঠিক আছে। তোমরা মেয়ে খোঁজ  করো। খুঁজে পেলে জানিও; এভাবে ছয়মাস কেটে গেল। পরিবার শর্তের ওপর মেয়ে দেখল। আমি ঐ মেয়ে গুলোর কিছু না কিছু খুঁত বের করি। শেষ পর্যন্ত পরিবার ক্লান্ত হয়ে আমার উপর দায়িত্ব ছেড়ে দিল, এক লাফে আমি কবিতাকে বিয়ে করে ফেললাম।
"এই শোন, একটা মর্মাহত ঘটনা। আমি মনে করলাম আমাকে ঘুম থেকে তুলতে নতুন বাহনা শুনে করেছে।
-কি হলো? বিরক্ত স্বরে বললাম!
ঢাকার চকবাজারে আগুন ধরে শত শত মানুষ নিহত।
-আমার কণ্ঠ হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, কি?
হুম হেড লাইনে কি বলছে শোন, আমার পাঠিকা বউ সুরেলা নিরীহ কণ্ঠে বলতে লাগলঃ

"১. গর্ভবতী স্ত্রী নামতে পারেননি; তাই স্বামীও নামেননি!
ফলাফল গর্ভের সন্তানসহ স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যু!

২. চার বন্ধু আড্ডা দিচ্ছিলেন প্রতিদিনের মতো। চারটি মাথার পোড়া খুলি পড়ে আছে!

৩. বাবার কাছে সন্তান বিরিয়ানি খেতে চেয়েছে! বাবা বিরিয়ানি নিয়ে ফিরে এসে এখনো পাননি সন্তানকে!

৪. জমজ সন্তানদের বয়স ১ বছরের মতো। মর্গে বাবাকে খুঁজছেন ।

৫. দুই ভাইয়ের জড়াজড়ি করা লাশ আলাদা করা যাচ্ছেনা। আলাদা করার পর তাদের বুকে জড়িয়ে ধরা শিশুর লাশ। শিশুকে বাচাঁনোর শেষ চেষ্টা করছিলেন দুই ভাই।

৬. ছেলে নর্থসাউথ এ পড়ে; সন্তানের লাশ চাচ্ছে তার মা। একটু মাংসের দলা হলেও চলবে। তিনি শেষবার বুকে জড়িয়ে ধরবেন।

৭. মৃত ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করে বাবাকে ফোন দিয়ে বলছে ভাইয়ের লাশ পাবার কথা।"

বউয়ের কথা শুনে আমার মাথা ভন ভন করছে। দুচোখ দিয়ে অবিরাম অশ্রু ঝড়ছে। নগরায়ন, প্রযুক্তি যেমন আমাদের উন্নতি করেছে তেমনি ক্ষতিও করতেছে। গ্রামকে শহর করলে হবে না, সব দুর্যোগের বিষয় মাথা রেখে নগরায়ন করতে হবে। ইত্যাদি বিষয় ভাবতে ভাবতে মাথা আউলা-ঝাউলা হয়ে যাচ্ছে।
বউয়ের চিকন ডাকে ধ্যান ভাঙল। এই তুমি কি আমাকে বিপদের সময় ছেড়ে দিবে?
আমি উঠে বউকে জড়িয়ে আবার চুপচাপ শুয়ে রইলাম দুজন। কিছুদিন পর আমরা তিনজন হতে যাচ্ছি। এই পাগলী বউটাকে কিভাবে বুঝায়, তাকে ছাড়া আমার জীবন অচল। বউকে আর একটু কোমল হাতে জোরে জড়িয়ে ধরলাম। বউয়ের ঘন ঘন নিশ্বাস আমার ঠোঁটের উপর।

"এই শামীম ভাই! এই ভাই বারোটা বাজে। আপনি বলেছিলেন ভার্সিটিতে দশটায় শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাবেন। এখনও ঘুমাচ্ছেন কেন?" রুমমেট চিৎকার দিয়ে ডাকছে। আমি জেগে উঠে দেখলাম; একটা কোলবালিশ ঝড়িয়ে ধরে আছি আর পুরো শরীর ঘেমে ভিজে গেছে!
আমি সেই চিরচেনা দুষ্টুমী হাসিটি দিয়ে বাঙালীদের মতো অজুহাত দাড় করিয়ে আমার এক কাজিনের ডায়লগটির সাথে আরেকটু যোগ করে রুমমেটকে বললাম; 'এক এলাকা থেকে একজন জানাজা পড়লে যেমন হয়, তেমনি ভাবে পুরো ইউনিটের একজন উপস্থিত না থাকলে কিছু হবে না। আমার ঘুমিয়ে পড়লাম … ।'

No comments