কোয়ারেন্টাইন কারাগার | ইফতেখার নিলয়

প্রথম কিস্তির পর - 



আকাশ ঘন মেঘে পর্দা টেনে রাখে। গাছের পাতার সবুজ আবরণে মন খারাপের চিহ্ন স্পষ্ট। কিন্তু, ঝুম বৃষ্টি আর নামেনা। মনের ভেতরে কেমন যেন আতঙ্ক! প্রতিমূহুর্তে মনে হয়, এই বুঝি! ভূমিকম্প হয়ে পৃথিবীটা ধ্বংস হতে যাচ্ছে। সারাদিনে এমন ভ্রম আমার কয়েকবার হচ্ছে ইদানীং, তাৎক্ষণিক জুতার তাকের উপর রাখা ছোট্ট পাতাবাহারের দিকে তাকাই, নাহ ও স্বাভাবিক আছে; একটুও নড়াচড়া করছে না। আমার মন আশ্বস্ত হয় ভূমিকম্প হচ্ছেনা। পৃথিবী স্থির আছে আমার মত। সারাদিনে আনুমানিক দশবার এই ভ্রম আমাকে অস্থির করে তুলছে। মানসিক শান্তি কফিনে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। মৃত্যুভয় তাড়া করে যাচ্ছে প্রতিক্ষণে, তাই প্রতিবার নিঃশ্বাস ফেলে  ভাবি ___ 'এই বুঝি বেঁচে আছি।'

সিঁড়ির ঘরে হাঁকডাক নেই। কারোই ওঠা-নামার সাড়াশব্দ পাওয়া যায়না। আগে ছাদে যাওয়ার প্রবণতা ছিলো যাদের, ওরা গ্রামের বাড়িতে পালিয়েছে। সহজ ভাষায় ওরা ভিন্ন কারাগারে। সবাই-ই আসলে এখন কারাগারে। কারো কারো ভাষায় চিড়িয়াখানায়। অনেকদিন ছাদের তালা খোলা হচ্ছেনা, তাই ছাদ বেয়ে সূর্যের আলো আমার ঘরে প্রবেশ করার উপায় নেই। ছাদ সম্ভবত এখন ধুলা জমে ভারী হয়ে গেছে। আমার পাশের  বিল্ডিং যেগুলো তুলনামূলক খাটো, ওগুলোর ছাদ আমাকে আমার মাথার উপর ছাদের ব্যাপারে এই ধারণা জন্মাতে বাধ্য করেছে। একপ্রকার প্রকৃতির সাথে আমাদের বিচ্ছেদের একটি খন্ডচিত্র এটি।

ইদানীং আমি শৈশবে ফিরে যাচ্ছি। আমি প্রচলিত ধারায় শৈশবকালীন সময় পার করিনি৷ কমিকস, কার্টুন, ভিডিও গেমস, খেলনা, মিমি চকলেট সহ যাবতীয় লোভনীয় জিনিসে আগ্রহের মাত্রা ছিলো নিম্নগামী। এক কথায় আমি ২০০২-২০০৭ এর প্রচলিত ধারার ছেলে-মেয়েদের মত সময় পার করিনি। আমি কাগজের নৌকা বানাতে পছন্দ করতাম। ভারী বর্ষার দিনে উঠোনে জমা পানিতে নৌকা ভাসাতে ভালোবাসতাম। কাগজের প্লেন বানিয়ে হাওয়ায় ভেসে বেড়াবার স্বপ্ন দেখতাম। কখনো কখনো ঘুড়ি আকাশে উড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা চালাতাম। ফেরীওয়ালা আসলে ছুটে যেতাম মুক্ত বিহঙ্গের মত। হাওয়াই মিঠাই কেন হাওয়া হয়ে যায় উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতাম।

বেশ কয়েকদিন হলো আমার ম্যাটাডোর হাই স্কুল টা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। শেষ কবে মুক্ত ছিলাম তাই তো মনে পড়েনা। যেদিন শেষ মুক্ত ছিলাম সেদিন সম্ভবত হাতে নিয়েছিলাম, এরপর আর নেওয়া হয়নি বলে, কোথায় রেখেছি স্মরণ নেই। সন্ধান পেলে মাথায় ঘোরপাক খাওয়া স্মৃতিগুলো লিখে রাখতাম। সে যাই হোক! বন্দিশালা থেকে মুক্তি মিললে যোগাড় করে নেওয়া যাবে নতুন কিছু ম্যাটাডোর হাই স্কুল। তখন বন্দিশালার স্মৃতিও জমা করে রাখবো।

স্মৃতি সবসময় ঘোরপাক খায়না। এখন স্মৃতি হানা দেওয়ার মূল কারণ, পেছনের বারান্দা থেকে হাতুড়ি পেটানো ঠক ঠক শব্দ কানে আসা বন্ধ রয়েছে। পেছনের বারান্দার কিছুদূরে নতুন একটা বিল্ডিং হচ্ছে। সারাদিন হাতুড়ি দিয়ে ইট ভাঙার ঠকঠক/ঠুসঠাস শব্দ মস্তিষ্কে জমাট বেঁধে ছিলো। অন্যকিছু ভাবার উপায় ছিলোনা। প্রচন্ড বিরক্তিকর! মাঝে মাঝে মন চাইতো গিয়ে  কয়েকটা চড় লাগিয়ে আসি। সারাদিন এত শব্দের মাঝে স্মৃতি রোমন্থন তো দূরে থাক! এই ঘরে থাকাই বিষের হয়ে উঠেছিলো।

মাসখানেক আগের সকালেও পত্রিকা আটকে থাকতো দরজার হাতলে। গত মাসের মাঝামাঝি তে হুট করে হকার গায়েব হয়ে গেলো! অর্ধেক মাসের বিলও রয়েছে তার বকেয়া। কোন কারাগারে আটকা পড়েছে খোদাতালা ছাড়া কেউই জানেনা। সে খুব চটপটে মানুষ। বাড়ি কুমিল্লার নাঙ্গলকোট। যদিও মুখের ভাষা তার নোয়াখাইল্লা। তার জীবনে সুখের সমাপ্তি নেই। প্রতিদিন এ বাসা! ও বাসা করে হাজারও বাসায় তার যাতায়াত, কত মানুষ তার চেনাজানা, কত মানুষের সাথে সাক্ষাৎ; সে কত জনপ্রিয়। এখন কতোটা অসুখী সে কারাগারে বন্দি অবস্থায় ?

সাফাইওয়ালা আসে নিয়মিত এখনও। তার বিশ্রাম নেই। তাকে মুক্ত রাখা হয়েছে দেশ পরিষ্কার রাখার জন্য। প্রতিদিন সকালে আসে, ময়লা নিয়ে চলে যায়। আগে দেখা হলে কথা হতো। এখন নানা বাঁধা-বিপত্তির মাঝে সুযোগ নেই কথা বলার। দূর থেকেই তাকে ময়লার বালতি টা দিচ্ছি, নইলে সে আসার আগেই দরজার বাইরে রেখে দিচ্ছি। তার চেহারা দেখি না আজ বহুদিন। কারাগারে নিয়ম করে দেওয়া হয়েছে কারো চেহারা দেখা গেলেও হাত মেলানো যাবেনা, যার সাথে দেখা হওয়ার পর হাত মেলানো যাবেনা তার সাথে দেখা হওয়ার-ই কোনো মানে হয়না। কারাগারের এই নিয়ম আমাদের দূরে ঠেলে দিয়েছে একে অপরের কাছ থেকে। পরিচিত মানুষের সাথে হাত না মেলানো অনেক কষ্টের, তাই আপাতত আমি নিজেকে বির‍ত রাখছি সাফাইওয়ালার সাথে দেখা করা থেকে।

সারাদিন শোয়া, আধা-শোয়া, দাঁড়িয়ে, বসে দিন কাটাতে কাটাতে ডান পাশে তাকাই ঘড়ির কাটায়। সময় জানান দেয় সে দ্রুত আগাচ্ছে না। ধীরে বহে মেঘনার মত তারও গতিতে ভাটা পড়েছে। ঘড়ির পেন্ডুলামটা দুপাশে ঢোলাঢুলি করে বিরামহীন। বেশীক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকা যায়না। চোখের দৃষ্টির একটা বিরতি প্রয়োজন হয়, চোখ ফিরিয়ে নিই, নয়তো মাথা অন্যদিকে ঘুরাই। মাথাও অস্থির হয়ে যায় একটানা দেখতে দেখতে। পেন্ডুলামের সাথে কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেছি, জানার চেষ্টা করেছি তার সুখ-দুঃখের কথা। সবাই হয়তো ভাবে পেন্ডুলামের জীবন তো থেমে নেই, সে দুঃখী হওয়ারও তাই কোনো কারণ নেই। তার জীবন তো স্বাভাবিক চলছে। থেমে নেই। অথচ পেন্ডুলামের দুঃখটাই সেখানে কারণ লোকে ধরেই নেয় যে তার কোনো দুঃখ থাকতে পারেনা। এই দুঃখ থেকেই পেন্ডুলাম আমাকে সাক্ষাৎকার দেয়না, আমাকে এড়িয়ে চলে। আমার চোখের দৃষ্টি কে ক্লান্ত করে দেয় একটানা তাকিয়ে থাকলে তার দিকে। নিরূপায় হয়ে আমিও তখন অন্যদিকে ফিরিয়ে নিই আমার চোখ।




চলবে....


No comments