রুহ ছুটে যাওয়া বিকেল | রাফসান গালিব

বিকালে অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়াইতেই সামনে দিয়ে ভোঁ করে দৌড়ে গেল গাড়িটা। ফোনে কথা বলছিলাম তখন, মাথা ঘুরে গেল। এই দৃশ্য কোনোভাবে ভুলতে পারতেছি না। ফাঁকা রাস্তা যেন সাপের মতো ফনা তুলল, শুনশান বিকালকে নাড়া দিয়ে।

বাসায় এসে ফ্রিজ থেকে বের করে রুমমেটের রেখে যাওয়া গাজরের হালুয়া খাইলাম, তার প্রেমিকা পাঠাইছিল। বেচারা লকডাউনে কিছুদিন আটকে পড়ে, পরে ক্যামনে ক্যামনে ভোরে ঢাকা ছাড়ছে, বউ পোলাপানের টানে ছুটছে গ্রামে।

মুড়ি দিয়ে কলাও খাইলাম। অনেকদিন পর ঢাকায় দেশি বাংলা কলা পাইলাম। কাল বিকালে অফিস থেকে ফিরতি পথে এক গলির ভেতরে বিক্রি করছিল। সিএনজি থামিয়ে নিলাম। চিটাগংয়ে থাকতে নিত্যদিনের নাস্তা কিংবা একটু ক্ষুধা পেলে এই কলাই ভরসা ছিল একমাত্র। যে কোনো সময় আরামচে খাওয়া যায়, মধ্যরাতেও। ঢাকায় অধিকাংশ জায়গায় শবরি কলা, সাগর কলা বা চম্পা কলা- মুখে দেয়া যায় না, কেমন জানি কষকষ বা বিষবিষ লাগে। চিটাগং গেলে কলা নিয়ে আসব আসব করে হয় না। অনেকদিন পর ঢাকায় পাইলাম কাল। খাইতে খুবই মিষ্টি। সকালে পান্তাভাতের সাথে মাখিয়েও খাওয়া যায়। মুড়ি দিয়ে তো অবশ্যই। এক মগ চা বানাই খাইতে খাইতে ছাদে পায়চারি করলাম কিছুক্ষণ।


ছবি: রাফসান গালিব। পান্থপথ সিগন্যাল।

পাশে উপরের ছাদে এক বাচ্চা এসে দাঁড়াইছে। চিন্তা করলাম দৃশ্যটা মাথা থেকে সরাইতে পিচ্চির সাথে কথা কই। জিজ্ঞাসা করলাম, কী নাম তোমার। কথা কয় না সে, বড় চানাচুরের প্যাকেট থেকে চুপি চুপি চানাচুর খায়৷ বোঝাই যাচ্ছে, মাকে না জানিয়ে এত বড় চানাচুরের প্যাকেট নিয়ে এসেছে। অনেক নাম বললাম, আকাশ বাতাস জামাল কামাল পিন্টু বল্টু শুভ্র জয় তারেক মুন্না বিল্লু জিয়া ফখরুল খোকা এরশাদ মুজিব নুরু পিকে হালদার- কোনোটাই না। যখন বললাম, চানাচুর চুরি খাচ্ছ, আম্মুকে বলে দিব। অমনি দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেল। এই বাচ্চার অনেক কাহিনি আছে, সে ল্যাংটা হয়ে ছাদে বাথটাবে গোসল করে, তার ওই পাশের আরেক ছাদ থেকে আরেকটু বড় তিনটা বাচ্চা মেয়ে তাকে দেখে আর মুচকি মুচকি হাসে। প্রায়ই এই দৃশ্য দেখি।

আশেপাশের বাচ্চারা কেন জানি আমার সাথে কথা কইতে চায় না। লম্বা লম্বা চুল দেখে হা হয়ে তাকায় থাকে। করোনার দিনে চুল তো আরও লম্বা হইছে। লকডাউনে সব সেলুন বন্ধ। গোঁফ দাড়ি সব মিলিয়ে ভুতুড়ে অবস্থা। আরেক ব্যালকনিতে পিচ্চি একটা কিচিরমিচির করে প্রায়ই। যেই আমি ছাদে বের হই চুপ মেরে যায় সে। নাম জিজ্ঞাসা করি, কিছু বলে না৷ পাখি ফুল বকুল শিমুল ময়না বাবুই চড়ুই হাসিনা খালেদা পাপিয়া বুবলি নুসরাত পিংকি টুনি কতকিছু জিজ্ঞাসা করি- কোনো নামই তার সাথে মেলে না। যেই জিজ্ঞাসা করি, আম্মু কী নামে ডাকে? তখন দৌড়ে রুমে ঢুকে যায়। বুঝি না, আম্মুর কথা বললেই এরা দৌড় মারে। হয়ত ভয় করে, চুলওয়ালা পাগলটা তাদের আম্মুকে নিয়ে যাবে।

সূর্য ডুবি ডুবি। কোনো ফাঁক দিয়ে চিকন আলো এসে পড়ছে ছাদে। গাঢ় কমলা আলো। আহ, এত করেও দৃশ্যটা ভুলতে পারছি না। মাথায় গেঁথেই আছে একেবারে।

বিকালে অফিস থেকে বের হয়ে গাড়ির স্টাফ মোতালেব ভাইকে ফোন দিলাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে। কইলাম, বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসতে। ওমনি সামনে দিয়ে ভোঁ মেরে একটা পিকআপ গাড়ি দৌড় দিল। ঘাঁড় ঘুরিয়ে ভাল করে দেখলাম, পিকআপে স্টিলের খাটিয়ায় লাশ রাখা। সাদা পিপিই পরা দুইজন লোক খাটিয়ার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত দিয়ে পিকআপের কিনার ধরে রেখেছে, চোখে গগলস, মুখে মাস্ক। পেছন পেছন একটা মোটরসাইকেল। সেখানেও দুইজন লোক, একইভাবে পিপিই পরা। করোনায় মারা গেল কিনা, জানার উপায় নাই। তবে দেখে মনেই হইল, এভাবেই তাকে কোথাও দাফন করা হবে, পরিবার পরিজন ছাড়াই, জানাযায় হয়ত ওই পিপিই পরা চার ব্যক্তিই থাকবে, আর কেউ না। মৃত ব্যক্তি পুরুষ কি নারী, বাবা কি ছেলে কি মেয়ে নাকি স্বামী কি স্ত্রী কিছুই জানার উপায় নাই। শুধু নিশ্চিত, যেই হোক তাকে শেষবারের মতো দেখার উপায় নাই আর কারও।

অফিসের সিএনজি স্টার্ট দিতেই উঠে বসলাম। বাংলামোটর পার হয়ে পান্থপথের দিকে চলে যাচ্ছে সিএনজি। অবাক হইতেছি, খালি সিএনজি কেন শুধু ওইদিকে যাইতেছে, আমারে না নিয়া? আমি কই? কাওরানবাজার থেকে শাহবাগের দিকে যে লাশের গাড়ি দৌড়ে গেল, আমি তো আসলে সেই দিকেই ছুটছি। আমার ছটফট রুহ তো সাদা প্লাস্টিকের কাফনের ভেতরে ঢুকে পড়তে চায় যেন। সিএনজি গাড়ি কারে দিয়ে আসতে যায়৷ ইঞ্জিনের শব্দ শুনে ছাদে দৌড়ে এসে কারে দেখবে বাচ্চাগুলা, যাদের নাম আদৌ জানা হয়নি আমার।

No comments